ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ফেসবুক পেজে রাবি শিক্ষার্থীর ‘যৌন হয়রানি’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৯
ফেসবুক পেজে রাবি শিক্ষার্থীর ‘যৌন হয়রানি’ আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড হেটস কনফেশন’ নামক ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্ট

রাবি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড হেটস কনফেশন’ নামক ফেসবুক পেজে ছবিসহ এক ছাত্রীর সম্পর্কে অশ্লীল, অশ্রাব্য, কুরুচিপূর্ণ এবং যৌন হয়রানিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বুধবার (৩ এপ্রিল) মধ্যরাতে একটি পোস্ট আপডেট করা হয়। মুহূর্তেই পোস্টটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী দেখেন।

কমেন্টের স্থলেও শুরু হয় ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্য। কেউ কেউ স্ক্রিনশট নিয়ে তাতে আরও ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্য জুড়ে দিয়ে শেয়ার করতে থাকেন ফেসবুকে।  

পরদিন বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) বিভিন্ন জনের আপত্তির মুখে দুপুরের দিকে পোস্টটি সরিয়ে ফেলেন পেজের অ্যাডমিন।

ততক্ষণে সামাজিক মাধ্যমে ওই ছাত্রীর বন্ধু-বান্ধব, বিভাগের সিনিয়র-জুনিয়র, শিক্ষক, হলমেটসহ সবাই দেখেছেন পোস্টটি। ফলে ওই ছাত্রীকে ব্যাপক সমালোচনার পাশাপাশি কুরুচিকর ও তির্যক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

ভুক্তভোগী ছাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘কিছুদিন ধরে একটি ছেলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করছিল। সম্পর্কে আমার বন্ধু হয়। তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেও সম্পর্কে জড়ানোর মতো ইচ্ছে ছিল না। বিভিন্নভাবে সে আমাকে ডিস্টার্ব করতো। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আমি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি। তখন সে  আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এর কয়দিন পরই এমন পোস্ট করে আমার সম্মান নষ্টের চেষ্টা করছে। ’
আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড হেটস কনফেশন’ নামক ফেসবুক পেজের অ্যাডমিনের সঙ্গে ভুক্তভোগী ছাত্রী কথোপকথন
ওই ছাত্রী আরও বলেন, ‘রাতে পোস্টটি দেখার পরপরই আমি পেজের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে তাকে পোস্টটির সরানোর জন্য অনুরোধ করি। তবে তারা এটা নিয়ে হাস্যরসাত্মক রিপ্লাই দিতে থাকে। পরে আমি আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা বললে, তারা উত্তর দেয়— “যা করতে চান করেন। আপনার সঙ্গে এতো কথা বলার সময় আমাদের নেই। ”

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘আমি মানসিকভাবে ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমার বাবা-মা বা এলাকার কোনো মানুষ যদি পোস্টটি দেখে থাকে, তবে তাদেরকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে; যে এমন কোনো কাজে আমি যুক্ত নই। ’

‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’ নামে কথিত বিনোদনমূলক পেজ থেকে দেওয়া এটাই প্রথম ‘যৌন হয়রানি ও বিদ্বেষমূলক’ পোস্ট নয়। জানা যায়, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের একজন বিবাহিত ছাত্রীর সম্পর্কে পেজে পোস্ট দেওয়া হয়। চাকরি সূত্রে খুলনায় অবস্থান করা তার স্বামীর কাছে পৌঁছে যায় ওই পোস্টটি। সেখান থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় পারিবারিক কলহ। যা তিন মাস পর বিবাহ বিচ্ছেদের রূপ নেয়। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ২০১৮ সালে আইন বিভাগের এক ছাত্রীকে উদ্দেশ্য করে ‘কুরুচিপূর্ণ’ পোস্ট করায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়।

অসংখ্য শিক্ষার্থীর অভিযোগ, এসব পেজে সামাজিক মর্যাদা খাটো করা হয়। তবে এ পেজগুলোর মাধ্যমে সাইবার অপরাধ বন্ধ করা বা এদের কার্যক্রম নজরদারি করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ক্রমেই বাড়ছে এ অপরাধ প্রবণতা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইংরেজি অদ্য অক্ষরে ‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’, ‘ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনস আরইউ’, ‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড হেটস কনফেশনস’সহ অন্তত ৮ থেকে ১০টি পেজের সন্ধান পাওয়া যায়। যেগুলোর মধ্যে দু’টি পেজে ২০ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার। যাদের অধিকাংশ রাবির সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের অনেক ব্যক্তিও সামাজিক মাধ্যমে এ পেজে যুক্ত। সবমিলিয়ে এসব পেজে অর্ধ লাখের বেশি সক্রিয় ফলোয়ার রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পেজগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকেনো ছাত্র-ছাত্রীর ছবিসহ তার সম্পর্কে তথ্য বা তাকে ভালো লাগার কারণ বা প্রেম করতে চাওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়। যে কেউ ফেক আইডি ব্যবহার করে ছবিসহ তথ্য সরবরাহ করলেই মুহূর্তেই তা প্রকাশ করা হয়। যা পৌঁছে যায় ফলোয়ারদের নিউজফিডে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পেজগুলোর এ ধরণের কার্যক্রমের মাধ্যমে গুরুতর সাইবার অপরাধ সংগঠিত করছে। রাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিবুল আলম প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যম বা কোনো ওয়েবসাইটে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। এটা ২০১৮ সালে অনুমোদন হওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গুরুতর অপরাধ। ’

তিনি বলেন, ‘আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামির তিন বছর জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পরবর্তীতে একই অপরাধ সংঘটিত করলে পাঁচ বছর জেল এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার দণ্ড হবে। ’

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বাংলানিউজকে বলেন, সাইবার অপরাধ বিষয়ে একটি টিম কাজ করছে। যদি তাদের দৃষ্টিগোচরের বাইরে কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়, সেটা যে কেউ অবগত করলেই ওই টিম খতিয়ে দেখেন। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, শুনেছি ফেসবুক পেজে ছাত্রীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে। যারা এমন কাজ করেছে এবং যারা তা প্রকাশ করেছে, কোনোভাবেই তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের স্বার্থে এবং নিরাপদ তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৯
জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।