ময়মনসিংহ: নগরীর গ্লোবাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া ইসলাম ইফতি (১৩)। স্কুলে আসা যাওয়া আর বাসায় বিরামহীন পড়াশোনার মধ্যেই আপন ভুবন।
কিন্তু কেন জানতে চাইলে ইফতির উত্তর- ‘বাবা-মা পড়াশোনাতেই জোর দিতে বলেছেন। তারা চান না প্রতিবেশী শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলে সময় নষ্ট করি। তাছাড়া বাইরে খেলার কোনো পরিবেশও নেই। ফলে অবসর সময়ে স্মার্টফোনে গেমস খেলি। কম্পিউটারে গান শুনি। এভাবেই সময় কেটে যায়। ’
বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাধুলার নাম ওরা পড়েছে কেবল পাঠ্যবইয়ে। কিন্তু বাস্তবে খেলাগুলো যেমন দেখা হয়নি তেমনি কখনো সমবয়সীদের সঙ্গে মেতে ওঠারও সুযোগ হয়নি।
একই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী কনিকা তাবাসসুম, রিন্তিকুজ্জামান নিঝুম ও তাসমিম আক্তার নওশিন। মাঠের খেলায় অভ্যস্ত নয় এ শিশুরাও। সকালে স্কুল শেষে বিকেলে বাসায় ফেরা। এরপর প্রাইভেট নয়তো কোচিং। সঙ্গে হোমওয়ার্কতো আছেই।
আনন্দহীন এক যান্ত্রিক জীবন। শৈশবের স্বাভাবিক উচ্ছলতায় মেতে উঠতে ইচ্ছে করে না? প্রশ্ন শুনে তিন কোমলমতির চোখ যেন ছানাবড়া! তাদের ভাষ্য- জীবনতো এটাই। এমন রুটিনই শিখিয়েছেন বাবা-মা।
সাদিয়া, নিঝুমদের মতোই ছোট্ট খোপে বেড়ে উঠছে দেশের অধিকাংশ কোমলমতি শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ না থাকায় তাদের যেমন আক্ষেপ নেই উল্টো বাসার সামনে খোলা জায়গাতেও ছুটোছুটির ইচ্ছে নেই। খেলাধুলা না থাকায় শরীরচর্চাও হচ্ছে না। অভিভাবকদের কঠিন বারণের মুখেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে শৈশব জীবন।
তাদের এমন অসচেনতার কারণে শিশু-কিশোরদের আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মূল্যবোধের অভাব থাকায় ভবিষ্যত জীবনে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অথচ একজন শিশুর দেহ-মন গঠনে খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ।
দেখা গেছে, ময়মনসিংহকে শিক্ষানগরী বলা হলেও এখানে ৬’শর বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। এক সময় খেলার মাঠ ছিল এখন সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল আবাসিক ভবন। আর এ আবাসিক ভবনেই দিব্যি মুরগির খোপের মতো ছোট্ট পরিসরে ক্লাস করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
সাপ্তাহিক ছুটি বাদে এক মাসের পুরো সময়ই ক্লাসরুমেই সময় কাটাতে হয় শিক্ষার্থীদের। ক্রীড়াচর্চার সুযোগ না থাকায় তাদের শারীরিক, মানসিক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়।
নগরীর রামবাবু রোড এলাকার শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ গড়ে উঠেছে একটি বহুতল ভবনের তৃতীয় তলায়। এখানে গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয় শিক্ষার্থীদের। আবাসিক এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠ নেই। এ প্রতিষ্ঠানের শিশুদের প্রতিদিনের জীবন থেকে খেলাধুলা শব্দটি যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
এ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী খাদেমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আসলে আমরা এখানে আবাসিক থাকি। গ্রামে গিয়ে আমরা খেলি। প্রতিবার ছুটি শেষে বিদ্যালয়ে ফেরার সময় অভিভাবকরাই বলে দেন শুধু পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকতে। তাই শিক্ষকরাও খেলাধুলা করতে দেয় না। আর একাডেমিক পড়াশোনার চাপে খেলার সময়ও নেই। ’
খেলাধুলার মাধ্যমে একজন শিশু শৈশব থেকেই সৃজনশীল হয়ে উঠে বলে মন্তব্য করেন ময়মনসিংহ কমার্স কলেজের প্রিন্সিপাল ড. এখলাছ উদ্দিন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, খেলাধুলা শারীরিক সক্ষমতা প্রমাণের পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। আবেগ নিয়ন্ত্রণ, আচরণ ও বন্ধু তৈরি করতে শেখায় খেলাধুলা। কিন্তু অভিভাবকরা নিজ শিশুর খেলাধুলায় গুরুত্ব না দেওয়ায় তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে।
অবশ্য আইরিন আক্তার নামে এক শিশুর অভিভাবক বাংলানিউজকে বলেন, এটা ঠিক, ক্লাসে শিক্ষক আসার আগে কিছুটা হৈ-হুল্লোড় করা ছাড়া শিশুরা খেলায় মেতে ওঠার সময় পায় না। ঘরের বাইরের পরিবেশও বিষাক্ত। বাসার সামনে খোলা জায়গা থাকলেও সেখানে মাদকাসক্ত বা বখাটেদের দৌড়ঝাঁপ রয়েছে। ফলে ভয় থেকেই কোন শিক্ষার্থীকেই বাইরে খেলতে দেন না অভিভাবকরা।
আমান উল্লাহ নামে আরেক শিশুর অভিভাবক বাংলানিউজকে বলেন, নগরীর স্কুলের যে অবস্থা বাচ্চাদের ক্লাসে দিয়ে অভিভাবকদের রাস্তায় ঘুরে ফিরে সময় কাটাতে হয়। বেশিরভাগ স্কুলের ভেতর বা মাঠে বসার জায়গা নেই। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়াই অনেক শিশুদের খেলাধুলার অভিজ্ঞতা।
শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে এক অভিভাবক বলেন, আমাদের শৈশব স্মৃতিতে রয়েছে স্কুলপ্রাঙ্গণে খেলার আনন্দ। স্কুলের বিশাল মাঠগুলোতে বিরতির সময়, ছাত্র-ছাত্রীদের দৌড়োদৌড়ি, খেলাধুলা ছিল ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। এজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ যেমন দায়ী তেমনি দায়ী আমাদের সমকালীন বাস্তবতাও। খেলতে গিয়ে সন্তানের বখাটে সঙ্গে নষ্ট হওয়াকেই বড় আতঙ্ক মনে করেন এখানকার অভিভাবকরা। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৯
এমএএএম/জেডএস