ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

অভিনব অভ্যর্থনায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নেন শিক্ষকরা!

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯
অভিনব অভ্যর্থনায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নেন শিক্ষকরা! শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন শিক্ষক। ছবি: বাংলানিউজ

খাগড়াছড়ি: যদি মা-বাবা সন্তানকে বলেন আজ বিদ্যালয়ে যেতে হবে না, তাহলে তার খুশি দেখে কে! কেননা বিদ্যালয় মানেই তো স্যারদের চোখ রাঙানি, কড়া শাসন কিংবা বেতের আঘাত। তাই বিদ্যালয়ে যেতে না হলেই যেন বেঁচে যায় সন্তানেরা।

তবে স্কুল নিয়ে এমন ধারণার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে খাগড়াছড়ির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ উদ্যোগ দেশে অভিনব।

সকালে ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান শিক্ষকরা। কখনো কোলাকুলি করে, কখনো হাতে হাত মিলিয়ে কখনোবা কোমড়ে হাত রেখে নাচের তালে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে। এতে শিক্ষকদের সঙ্গে কোমলমতি শিশুদের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনই কাটছে ভীতি। শিশুদের মেধা বিকাশ, স্কুলমুখী করার ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ ভূমিকা রাখছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগে খুশি অভিভাবকরাও।

জানা যায়, চলতি বছরের আগস্টে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে সারাদেশের ২৫জন কর্মকর্তা ও শিক্ষক চীন সফর করেন। মূলত জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকদের নিয়ে ৭দিনের এই সফরটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে খাগড়াছড়ির খাগড়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশা প্রিয় ত্রিপুরাও অংশ নেন। তিনি ২০১৪ ও ২০১৫ সালে টানা দু’বার জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন।

সফরকালে বেইজিংয়ের শিক্ষা সম্পর্কিত একটি সেমিনারে অংশ নেন তারা। যেখানে চীনের শিক্ষা ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের ব্যবহার, পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

তিন ধরনের অভ্যর্থনা পায় শিক্ষার্থীরা।  ছবি: বাংলানিউজ

আশাপ্রিয় ত্রিপুরা জানান, সফরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের বন্ধুসুলভ ব্যবহারের আলোচনার বিষয়টি আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু কীভাবে এই সম্পর্ক বৃদ্ধি করবো, শিক্ষক ভীতি কাটিয়ে কোমলমতি শিশুদের জন্য কীভাবে আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

তিনি বলেন, ‘৩ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চীনের একটি বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়ার ভিডিও দেখে অভিজ্ঞতা নিই। পরে বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে আমরা শিশুদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়াটা শুরু করি। ’

শিক্ষার্থীরা বেছে নেয় কীভাবে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হবে।  ছবি: বাংলানিউজ

বিদ্যালয়টিতে প্রাক প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত বর্তমানে ২৫০জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইন্দুতা ত্রিপুরা জানান, ক্লাস শুরুর ১৫ মিনিট আগে আমরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসের সামনে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয়। তারপর দেয়ালে লাগানো ৩টি প্রতীক থেকে শিক্ষার্থীরা যেটা পছন্দ করবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয় সে অনুসারে। এরমধ্যে ‘লাভ’ প্রতীক পছন্দ করলে তার সঙ্গে কোলাকুলি, যদি ‘পাঞ্জা’ পছন্দ করে তখন তাদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে তালি দেওয়া হয়। আর ঝিকঝাক পছন্দ করলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে নাচেন।

খুশি অভিভাবকরাও।  ছবি: বাংলানিউজ

কথা হয় বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ধৃতি ত্রিপুরা ও রোদর্শী চাকমার সঙ্গে। তারা জানায়, তারা যখন স্কুলে আসে তখন স্যাররা তাদের অনেক আদর করেন। স্যার এবং ম্যাডামরা তাদের সঙ্গে হাত মেলায়, কোলাকুলি করে, নাচ করে। তাদের এ বিষয়টি অনেক ভালো লাগে।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল্পনা ত্রিপুরা ও সোহেলী চাকমা জানান, নতুন এই উদ্যোগের কারণে বাচ্চারা এখন অপেক্ষায় থাকে কখন স্যারদের সঙ্গে হাত মেলাবে, নাচবে। শিক্ষকদের সঙ্গে শিশুদের দূরত্ব অনেক কমেছে। তারা এখন সহজে নিজেদের সমস্যার কথা শিক্ষকদের বলছে।

নাইম্রাও মারমা ও প্রীতি ত্রিপুরা ওই স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তারা জানান, আগে তো স্যাররা শাসন করার কারণে বাচ্চাদের ভেতর একটা ভয় কাজ করতো। বিদ্যালয়ে যেতে চাইতো না। কিন্তু এখন স্যারদের বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য বাচ্চাদের এখন স্কুলে যেতে বলতে হয় না। তারা স্কুলে গিয়ে আনন্দ পায়।

এদিকে এমন উদ্যোগের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যবহারকারীরা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানান। তারা বলছেন, ব্যাতিক্রমী এমন উদ্যোগের ফলে শিশুরা আনন্দ, বিনোদনের মধ্যে পড়াশোনায় মনযোগী করার পাশাপাশি মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখবে।

খাগড়াছড়ির সচেতন নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাছির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বিদ্যালয়ে যেভাবে প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগে শিশুদের অভ্যর্থনা জানানো হয় এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এমন উদ্যোগের ফলে শিক্ষক ভীতি কাটবে, শিশুরা স্কুলমুখী হবে। একটি বন্ধুসুলভ পরিবেশে বাচ্চা লেখাপড়া করতে পারবে। এমন উদ্যোগ অন্য বিদ্যালয়গুলোতেও নেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯
এডি/এইচএডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।