তাদের এ অবস্থানের পর সম্পত্তি রক্ষায় কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা, প্রয়োজনে আইনের দারস্থ হতেও দ্বিধাবোধ করবেন না বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. মনিরউজ্জামান।
তবে মুখে নয় এর বাস্তবে বাস্তবায়ন চান স্থানীয়রা, সেসঙ্গে লিজের নামে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনা হটিয়ে বিদ্যালয় ও এর আশপাশের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী করে তোলার আহ্বান তাদের।
জানা গেছে, ১৯২৭ সালে ২ একর ৮৩ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী রাজাপুর মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্নভাবে বিদ্যালয়ের সম্পত্তি স্থানীয় মানুষের সহায়তায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের বিশাল এই সম্পদ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে যেভাবে পেরেছে লিজের নামে নিজের কব্জায় নিয়েছে। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সহায়তায় কখনো মার্কেটের নামে, কখনো ব্যাংকের নামে কিংবা অন্য কোনোভাবে জমি বেদখল হয়েছে। নামমাত্র টাকার ৯৯ বছরের লিজে বিদ্যালয়ের বিশাল সম্পত্তিজুড়ে মার্কেট উঠিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন অনেকে। কেউবা প্রভাব ও কৌশল খাটিয়ে বিদ্যালয়ের সম্পত্তির ওপর গড়ে ওঠা ভবন নিজ জিম্মায় রেখেছেন, আবার কেউ লিজের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে তা বিক্রি করে দিয়েছেন অন্যের কাছে।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৮৯ সালে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমিও ছিলাম। ওইসময় থেকেই দেখেছি যে যেভাবে পেরেছে বিদ্যালয়ের জমি লিজের নামে দখলের চেষ্টা চালিয়েছে। দখল করতে করতে আজ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, প্যারেড মাঠ ছোট হয়ে গেছে। আবার বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে যে ভবন তৈরি করার জায়গা পাচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। প্যারেড মাঠ নয়তো অন্যভবনের মধ্যে ঢুকে বিদ্যালয়ের নতুন ভবন বানাতে হচ্ছে।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী দুলাল তেওয়ারী বলেন, বিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গাতে জায়গা থাকা সত্ত্বেও, কৌশলগতভাবে প্যারেড গ্রাউন্ডকে সংকীর্ণ করে গত ৩/৪ বছরে কয়েকটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ভবনগুলো ক্যাম্পাসের পেছনের জায়গা, ভোকেশনাল ক্যাম্পাস এবং প্রধান শিক্ষকের বাসভবন সংলগ্ন জায়গায় করা যেতো। এতে যেমন বিদ্যালয়ের ১২শ শিক্ষার্থীর শিক্ষার পরিবেশ বজায় থাকতো, তেমনি বিদ্যালয়ের সম্পত্তি সুরক্ষিত থাকতো। কিন্তু কৌশলগতভাবে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের যোগসাজেশে ভবন তৈরি করায় এখন অনেক জমিই চোখের আড়াল হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন সময়ে লিজসহ বিভিন্ন অযুহাতে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে দখলের পাঁয়তারা চলছে। যা কোনোদিনই কাম্য নয়। আমরা বিদ্যালয়ের সম্পত্তি বিদ্যালয়ের থাক সেটাই চাই যা সীমানা প্রাচীর দিয়ে সংরক্ষণ করা হোক।
তিনি বলেন, জমির লিজের বাইরেও বিদ্যালয়ের ভোকেশনালের ভবন ও ছাত্র-শিক্ষক মিলানায়তনের কার্যক্রম বন্ধ করে সেগুলোকে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার অনুকূলে তার পার্শ্ববর্তী জায়গা দখলের পাঁয়তারা চলছে।
এদিকে স্থানীয়রা জানান, বিদ্যালয়ের সম্মুখে সড়কের পাশে একটি টয়লেট ভেঙে নতুন করে স্কুল কর্তৃপক্ষ দোকানঘর তোলার পাঁয়তারা চালাচ্ছিলো, তখন প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের জমি অবৈধ দখলরোধে আন্দোলনে নামে।
স্থানীয়রা আরও জানান, বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বিদ্যালয়ের জায়গাতে ভবন নির্মাণ করে থাকেন। যা লিজের জমি ছিলো। অন্য এক ব্যক্তি বিদ্যালয়ের কাছ থেকে লিজ নিয়েছেন। আর পরবর্তীতে তিনি বর্তমান বসবাসকারী শিক্ষকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে সেখানে ভবন উঠিয়ে দোতলায় থাকছেন ওই শিক্ষক, আর নিচতলা ভাড়া দিয়েছেন। এছাড়া বিদ্যালয়ের জমি লিজ নিয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটি ভবন করেছিলো, পরে সেই জায়গাতে তাদের সংকুলন না হওয়া অন্যত্র নেওয়া হয় ব্যাংকটিতে। কিন্তু সেই ভবন এখন অন্যের দখলে। এছাড়াও বিদ্যালয়ের সামনের বিশাল জায়গা নামমাত্র মূল্যে লিজ দেওয়া হয়েছে। যে জায়গাতে, যে যার ইচ্ছেমতো পান-সিগারেটসহ নানান কিছুর দোকান বসিয়ে নিয়েছেন। যা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানটির ও তার আশপাশের পরিবেশ নষ্ট করছে।
বর্তমানে লিজের আওতায় ও বেদখলে প্রায় ২৪ থেকে ২৫ শতাংশ জমি রয়েছে জানিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ৯ একর সম্পত্তি সঠিক নয়, বিএস রেকর্ড অনুযায়ী বিদ্যালয়ে প্রায় ৭ একর সম্পত্তি রয়েছে। ১৯৯০-৯১ সালে ম্যানেজিং কমিটি কিছু জমি লিজ দিয়েছে দোকান হিসেবে। সেখানে সামান্য কিছু ভাড়া দেয়, যা দোকান প্রতি ৮০ থেকে ১২৫ টাকা করে। যা নিয়ে আমরা একাধিকবার দেন দরবার করে কিছুটা অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু স্থানীয়রা এসব দোকানের বিপক্ষে অবস্থান। তারা স্কুলের সম্পত্তি স্কুলেরই থাক লিজের প্রয়োজন নেই এমনটা চাচ্ছেন।
১৯৯০-৯১ সালে বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ জমি লিজ হয় জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কোনো লেনদেন নেই, তারা ভবন ছেড়ে দেওয়ার পর সেটি লিজ দেওয়া হয়। এটা আমরা উদ্ধারে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।
মনির স্যারের ভবনের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ’৯০-৯১ সালে বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ওই জমি লিজ নিয়ে মনির স্যারের কাছে বিক্রি করে গেছেন। সেটাও আমরা উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. মনিরউজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের সময়ে কোনো লিজ দেওয়া হয়নি এবং এ ধরনের পরিকল্পনাও নেই। স্কুল কমিটি লিজ দিতে পারে না বলেই আমি জানি, স্কুল কমিটি পারে স্টল করে ভাড়া দিতে। অনেক আগে যখন শাজাহান ওমর সাহেব আমাদের সংসদ সদস্য (এমপি) ছিলেন তখন তিনি এ বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন তখন কিছু জমি সামান্য পয়সায় লিজ (মালিকানা ও ভাড়া) দেওয়া হয়েছিলো। তবে সেসময় নামমাত্র ভাড়া ছিলো কিন্তু সেটা আমরা এখন একটা পর্যায়ে এনেছি। আগে যেখানে ভাড়া ৩ থেকে ৪ হাজার আসবে সেখানে ৩৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। আর সোনালী ব্যাংকের ভবন যিনি নিয়েছেন, তাকে আগে কমিটি লিজ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, সবমিলিয়ে বেদখল হওয়া সব সম্পত্তি ফিরিয়ে আনা হবে বিদ্যালয়ের অনুকূলে, প্রয়োজনে আদালতের দারস্থ হবো। আর আমাদের কোনো লিজ দেওয়ার চিন্তাভাবনা নেই। বরং সবকিছু নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫১ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২০
এমএস/এএটি