ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

পুষ্টি চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও মেলে না হলের খাবারে

মঈন উদ্দিন, রাবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২২
পুষ্টি চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও মেলে না হলের খাবারে

রাবি: এক টুকরো গোশত অথবা মাছের সঙ্গে বাজারের সবচেয়ে কম দামে কেনা আলুর ঝোল। মাংস বা মাছের টুকরো খুঁজতে ওই ঝোলের মধ্যে নামতে হয় ডুবুরির ভুমিকায়।

সঙ্গে এক প্লেট ভাত। অতিরিক্ত বলতে ভাতের মাড়ে হলুদ মিশিয়ে রঙ আনা কথিত ডাল। নেই কোনো সবজির শ্লেষ।

দেশের অন্যতম বিদ্যাপিঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আবাসিক হলের ডাইনিং, ক্যান্টিন ও ক্যাম্পাসে নিয়ম বহির্ভূতভাবে যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা খাবার দোকানে পাওয়া সেরা খাবারের মেন্যু এটি। তাতেই ৪০-৫০ টাকা বিল। বিক্রির চাপ বাড়লে কখনও তা বেড়ে যায় আরও ১০-১২ টাকা।

সরেজমিনে দেখা যায়, আবাসিক হলের ডাইনিং, ক্যান্টিন, খোলা দোকান সবখানে খাবার রান্না ও পরিবেশন হয় চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে থাকা দোকানগুলোর এস্টেট শাখা থেকে অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা নেয় না কেউ। সেখানে খোলা পাত্রে রাখা খাবার ধুলাবালিতে মাখামাখি হয়ে যায় সহজেই। ভন ভন করে বসছে মাছি। দোকান মালিক-কর্মচারীদের তাতে নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। সেই খাবারই পরিবেশন করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। প্রায় সব দোকানে খোলা আকাশের নিচে হাতের ওপর প্লেট রেখে খাওয়ার পদ্ধতি চালু রয়েছে। খাবার পরিবেশনে ব্যবহৃত প্লেট, বাটি ও গ্লাস ধোয়া বলতে একজনের খাওয়া পাত্র নোংরা পানিতে ডুবিয়ে তুলে তাতে আরেকজনকে দেওয়া হচ্ছে খাবার। সঙ্গে খাওয়ার জন্য সরবরাহ করা হয় ট্যাপের ময়লাযুক্ত অথবা টিউবওয়েলের আয়রণযুক্ত লালচে পানি।

আর হলগুলোর রান্নাঘর যেন ময়লার ভাগাড়। সেখানে কর্দমাক্ত অবস্থায় পঁচা আলু, ধুলাবালির মধ্যে পাথরে ভরা চাল স্তূপ করে রাখতে দেখা যায়। রান্নার ডেক ও হাড়ি-পাতিলগুলো কতদিন ধোয়া হয়নি বলতে পারবেন না কেউ। মাছির ভন ভন আওয়াজ শুনলে যে কারও মনে হবে, এগুলো পরিত্যক্ত কক্ষ। দুপুরে বিক্রি না হওয়া অবিশষ্ট খাবার রাতের জন্য রান্না করা খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এসব খাবার খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থী।

রাবি মেডিক্যাল সেন্টারের দু’জন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বাংলানিউজকে জানান, যারা নিয়মিত হলে খায় তাদের বড় একটা অংশ শুধু নিম্নমান ও অপুষ্টিকর বাসি-পঁচা খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী প্রত্যেকের দিনে অন্তত দুই হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ক্যালরি প্রয়োজন। স্বাভাবিক জীবনধারণ ও পড়াশোনা ঠিকমত চালিয়ে যেতে এটা অবশ্যই দরকার। তবে ক্যাম্পাসে যে খাবার পাওয়া যায়, তাতে প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ ক্যালরিও থাকে না। প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে না বললেই চলে। ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা ও শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে প্রচুর শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে আসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এর মধ্যে আবাসিক হলে থাকেন প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী। পার্শ্ববর্তী মেস বা ভাড়া বাড়িতে থাকা শিক্ষার্থীরাও দুপুরের খাবার ক্যাম্পাসে খেয়ে থাকেন। কিন্তু এসব দোকানে বিক্রি হওয়া খাবারের মান খুবই নিম্ন ও পুষ্টিহীন। তাও খেতে হয় চড়া মূল্যে। ছত্রাকের মত ক্যাম্পাসে এখানে-সেখানে গজিয়ে ওঠা এসব দোকানের খাবারের মান ও মূল্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মনিটরিংও করা হয় না। ফলে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করেও ব্যবসায়ীরা লাগামছাড়া দাম নিচ্ছেন।

আবাসিক হল সূত্র জানায়, ছাত্রদের ১১টি এবং ছাত্রীদের ৬টি হলে অবস্থান করা প্রায় সাড়ে ৯ হাজার শিক্ষার্থীর খাবারের জন্য হল ডাইনিং ও ক্যান্টিন একমাত্র ভরসা। ডাইনিং ও ক্যান্টিন নামেই শুধু ভিন্ন। খাবার মেন্যু একই রকম। পার্থক্য বলতে ডাইনিংয়ে প্যাকেজ সিস্টেম আর ক্যান্টিনে খাবারের ওপর ভিত্তি করে বিল মেটাতে হয়। ডাইনিংয়ে ২৪ টাকার বিনিময়ে দুপুরে ও ১৮ টাকায় রাতের খাবার পাওয়া যায়। ২৪ ও ১৮ টাকার প্যাকেজে খাবার বলতে ওই একটু টুকরো মাংস অথবা মাছ কিংবা অর্ধেক ডিম ভাজি। সঙ্গে পঁচা আলুর ঝোল ও ভাতের মাড়ে হলুদ মেশানো ডাল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ডাইনিংয়ে খেতে আসা শিক্ষার্থী রাশেদুল মুবিন আক্ষেপ করে বাংলানিউজকে বলেন, বাজারের সবচেয়ে নিম্নমানের চাল ও পঁচা আলু কিনে হলের ক্যান্টিন, ডাইনিং ও খাবার দোকানগুলোতে রান্না হয়। কারাগারের দুর্ধর্ষ অপরাধীদেরও এর চেয়ে ভাল খাবার পরিবেশন করা হয়।

আরেক শিক্ষার্থী খায়রুল আলম বলেন, গন্ধযুক্ত চাল ভালোভাবে ধুয়ে রান্না না করায় অনেক সময় রান্নার পরও থাকে প্রকট দুর্গন্ধ। টাটকা তো দূরে থাক, ন্যূনতম কোনো শাক-সবজি কখনও পাওয়া যায় না। ২৫০ গ্রাম ডাল দিয়ে পাঁচ গামলা ডাল রান্না করা হয়। হলুদের গন্ধে তাতে মুখ দেওয়া সম্ভব নয়। এসব খাবার খেয়ে প্রায়ই বমি ও পেটের পীড়ায় ভুগতে হয়। ভালো চিকিৎসক দেখালে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের তাগাদা দেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পাসে ভাল কোনো রেস্তোরাঁ না থাকায় টাকা থাকলেও এর বাইরে ভাল খাবার মেলে না।

জানতে চাইলে হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক ড. জাহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি হলে খাবারের মেন্যু টানিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। খাবারের মান তদারকির জন্য হলের আবাসিক শিক্ষকরা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। তবে খাবারের মান আরও বাড়ানোর জন্য টাকা বাড়াতে হবে।

উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে হলের খাবারের মান যাচাই করছি। হল প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি যাতে প্রতিদিনের মেন্যু কার্ড আগেই প্রকাশ করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো খাবার খেতে পারবে। আর মেন্যুতে নতুন কিছু যুক্ত করার বিষয়েও আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি।

তিনি আরও বলেন, হলের রান্নার জন্য পানি, তেল ও বিদ্যুতে ভুর্তুকি দেওয়া হয়। এর বাইরে টাকা দেওয়ার জন্য কোনো ফান্ড নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইউজিসির কাছে খাবারের ভর্তুকির জন্য নতুন করে অর্থ বরাদ্দের জন্য আবেদন করার চিন্তাভাবনা করছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।