ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

কলকাতা থেকে জনি হক

বাংলাদেশই বাংলা ভাষাটা ধরে বেঁচে আছে

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
বাংলাদেশই বাংলা ভাষাটা ধরে বেঁচে আছে হীরক দাশগুপ্ত

কলকাতা থেকে: দুই বাংলায় যারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা কনসার্ট আয়োজন করেন, তাদের কাছে আস্থার আরেক নাম হীরক দাশগুপ্ত। শিল্পীদের নিয়ে আসা ও নিয়ে যাওয়ার বেলায় তার মতো স্বচ্ছতা খুব কম আয়োজকই দেখাতে পেরেছেন।

এখানেই তিনি আলাদা। এজন্যই ক্রমাগত বাড়ছে তার জয়যাত্রা।
 
হীরক দাশগুপ্ত থাকেন কলকাতায়। পৈতৃক ও মায়ের সূত্রে তিনি একজন বাংলাদেশিও। তাদের ভিটেমাটি চট্টগ্রামে। তাই বাংলাদেশের জন্য তার আলাদা টান আছে। সেজন্য নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে চলমান বাংলাদেশ বিজয় উৎসবের তৃতীয় দিনের (বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর) আয়োজনে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন তিনি।
 
এদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গায়িকা রুনা লায়লা। বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) সকালে এসে পৌঁছেছেন তিনি। এই আয়োজন, নিজের প্রতিষ্ঠান তালাশ মিডিয়া অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট, সাফল্য ও আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে বসে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন হীরক দাশগুপ্ত।
 
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ বিজয় উৎসবের তৃতীয় দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা করছেন আপনি। কীসের টান এটা?
হীরক দাশগুপ্ত: দেখুন, বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে চরম উৎসাহ। কারণ আমরা এখানে যতো লোক বাস করি তাদের বেশিরভাগেরই পরিবারের কারও না কারও শেকড় বাংলাদেশ। ধরুন মায়ের দিকে হোক, বাবার দিকে হোক, একটা নাড়ির টান আছেই। আমার বাবা-মা দু’জনের বাড়িই চট্টগ্রামে। আমার মতো প্রচুর পরিবার আছে পশ্চিমবঙ্গে। আপনি এখানে এসে দেখতে পাচ্ছেন, বাংলাদেশ থেকে শিল্পীরা এখানে এসে গাইছেন আর তাদের পরিবেশনা নিয়ে এখানকার দর্শক-শ্রোতার মধ্যে বিপুল আগ্রহ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের এই উদ্যোগটার সঙ্গে আমরা যারা শামিল হয়েছি, তারা ইতিহাসের অংশ হলাম। কারণ এতো বড় আঙ্গিকে কখনও বাংলাদেশের বিজয় উৎসব এখানে উদযাপন হয়নি। আগে কলকাতাস্থ ডেপুটি হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ছোট আকারে হয়েছে। এ উৎসবকে ঘিরে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে যে জমায়েত হচ্ছে, এটা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়।  
 
বাংলানিউজ: রুনা লায়লাকে নিয়ে আসার ব্যাপারে বলুন।
হীরক: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রুনা লায়লাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। আমি মনে করি, বাংলাদেশ বিজয় উৎসবে তিনিই সবচেয়ে যুতসই শিল্পী। তিনি দেশাত্মবোধক অনেক গানও গেয়েছেন। উপমহাদেশের নামি শিল্পী তিনি। তাকে নিয়ে আসার আরও একটা কারণ, ভারতবর্ষে তার প্রচুর ভক্ত আছে।  
 
বাংলানিউজ: তালাশ মিডিয়া অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট দুই বাংলার শিল্পীদের নিয়ে কী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে?
হীরক: আমাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশি শিল্পীদেরকে আরও বেশি করে এখানে নিয়ে আসবো। নচিকেতার সঙ্গে আমরা খুব তাড়াতাড়ি একটা কাজকর্ম শুরু করবো। এতে বাংলাদেশের অনেক শিল্পীকে রাখার চিন্তাভাবনা করছি, যারা ফোক ধাঁচের গান একটু বেশি করেন। এই প্রয়াস নিরন্তর চলবেই। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, অর্ণবের প্রচুর চাহিদা আছে এখানে। আমাদের কাছে তাদেরকে নিয়ে আসার প্রচুর প্রস্তাব আসছে। আমরা চাই, এই জায়গা আর সংখ্যাটা আরও বাড়ুক। আর বাড়বে তখনই যখন আরও বেশি প্রচার পাবে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এসব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করলেই কেবল এটা সম্ভব।
 
বাংলানিউজ: আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম তালাশ কেনো?
হীরক: আমি যখন প্রথম মিডিয়াতে কাজ করতে আসি, যখন থেকে ভেবেছি শো করবো, ইভেন্টস করবো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবো, তখন নামটা তালাশ দিয়েছি এজন্য যে, আমিও তালাশ করছি কাদের সঙ্গে কাজ করবো, একইভাবে তারাও তালাশ করুক আমাকে, যাদের মানসম্পন্ন ইভেন্ট করার ইচ্ছে আছে। আমার সৌভাগ্য, সবার বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছি। আর আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ভারতবর্ষে যতো শো করি, বাংলাদেশে সে হিসাবে কোনো অংশে কম শো করি না। আমরা শুধু ইভেন্টসে নেই; প্রোডাকশনে আছি, শো ডিজাইনিংয়ে আছি, শিল্পী ব্যবস্থাপনায় আছি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিল্পীদের জন্য যথাযথভাবে শো ডিজাইন করা। ভালো মানের শব্দ ব্যবস্থাপনা, মঞ্চ তৈরি করা-এসব ব্যাপারেও গুরুত্ব দেই। আর আমি আগের চেয়ে চুজি হয়ে গেছি। এখন বেছে বেছে পেশাদার মানুষদের সঙ্গে কাজ করবো।
 
বাংলানিউজ: তালাশের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো কী কী?
হীরক: প্রথমে কলকাতার ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পলকে নিয়ে সেলিব্রেটি ফ্যাশন শোর আয়োজন করি। এক্ষেত্রে আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন নূর ভাই (আসাদুজ্জামান নূর)। তিনি এখন আপনাদের সংস্কৃতি মন্ত্রী। আমি তার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। এরপর অরিজিৎ সিং, শ্রেয়া ঘোষাল, সুনিধি চৌহান, অনুপম রায়, নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, সুস্মিতা সেনকে নিয়ে গেছি বাংলাদেশে। এখন আমার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক জগতের লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা হয়েছে।
 
বাংলানিউজ: আপনি তো অন্য পেশায় থাকতে পারতেন। এটা বেছে নিলেন কেনো?
হীরক: আমি মূলত মার্কেটিংয়ের লোক। আমার একটা প্রফেশন আছে। মূলত আমি একজন লাইফ কোচ, ট্রেনার, মোটিভেশন করাই। আমি প্রচুর ট্রেনিং প্রোগ্রাম আয়োজন করেছি। নিজে ট্রেনিং করিয়েছি, প্রচুর বড় বড় ট্রেনারের সঙ্গে কাজ করেছি। ক্যারিয়ারে এক হাজারের ওপর সেমিনার করেছি। এমনকি চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে বিবিএ-এমবিএ শিক্ষার্থীদেরকে মার্কেটিংয়ের ওপর লেকচার দিয়েছি। এটাও কিন্তু এক ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। আমার সবসময় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে খুব ভালো লাগে। আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো একটা ব্যবসা শুরু করা যায় কি-না। কিন্তু না আমি পণ্য বাজারজাত করি, না আমার শাড়ির ব্যবসা আছে, তাহলে কি করতে পারি? আমি দেখলাম, আমার পরিবারের মধ্যে ভাই-দাদারা মিডিয়াতে আছেন। তো আমার মনে হলো, ওদের সূত্র ধরেই একটা কাজ শুরু করা যেতে পারে। সেভাবে আমি ভাবলাম। তারাও আমাকে উদ্বুদ্ধ করলেন। তাদেরও এখানে মানে ভারতে মিডিয়ার কাজকর্ম করার জন্য একজন বিশ্বস্ত লোক দরকার মনে হচ্ছিলো। এরপর আলাপ হলো। এভাবেই কাজ শুরু করলাম। ছোটবেলায় নিজে লিখতাম। মার্কেটিংয়ের জায়গায় এসে বা পেশাগত ব্যস্ততার কারণে লেখালেখি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছি। সেই সৃজনশীল মাধ্যমে ফিরে আসার তাগিদেই এ কাজটা শুরু করি। সে তাগিদেই প্রোডাকশন, ইভেন্ট ও শো ডিজাইনিং করা।
 
বাংলানিউজ: চট্টগ্রামে আপনার দাদা বাড়ি ও নানা বাড়ি। বাংলাদেশি হলে আরও ভালো হতো মনে হয়?
হীরক: থাকলে কি হতো আমি জানি না। বাংলাদেশে থাকলে ভালো হতো নাকি এখানে আছি বলে ভালো আছি, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে গেলে মনে হয়, সেখানকার মানুষ এখনও বাংলাকে ধরে বেঁচে আছে। আর পশ্চিমবঙ্গে আমরা বেড়ে উঠি মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে। আমরা কিন্তু বাংলাকে ধরে বেঁচে নেই। আমরা বাংলাকে লালন করছি। আমি আপনার কাছ থেকে বেরিয়ে হয়তো কোনো একজন পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গে কথা বলতে যাবো, দেখা যাবে তার সঙ্গে আমি হিন্দিতেই কথা বলছি। তবে আমি চেষ্টা করি, বাংলাকে ধারণ করার। আমি কিন্তু প্রায়ই চট্টগ্রামে যাই, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিই। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত আছে আমাদের। আত্মীয়দের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঠিকই হয়। আর কলকাতায় আমার পরিবারে নিয়মই হচ্ছে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলা। তাই আমার ছেলে সৌরাশীষ দাশগুপ্ত হিমুও এ ভাষাটা বোঝে। যদিও মাত্র সিক্সে পড়ছে সে। হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ছেলের নাম রেখেছি। উনি আমার প্রিয় লেখক ছিলেন। মৃত্যুর পর কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলা তার নামে উৎসর্গ করা হয়। তখন আমি দেখেছি, তার বই লাইন ধরে কিনছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছে তার ছবি। নূর ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিলে হুমায়ূন আহমেদের আরেক বিখ্যাত চরিত্র বাকের ভাই নিয়ে কথা হয়।
 
বাংলানিউজ: আপনার আগামী পরিকল্পনা কী?
হীরক: আমরা অনেক বড় বড় শো ভাবছি। এখনই বিস্তারিত বলছি না। এমন এমন লোক যারা বাংলাদেশে যাননি, তাদের মতো বিখ্যাত লোককে নিয়ে আমরা শো ডিজাইন করছি। সেরকম কোনো সুযোগ যদি পাই বাংলাদেশে উপস্থাপন করার, তাহলে তা বাস্তবায়ন করতে পারবো। শুধু গান বা সংগীতশিল্পী নয়; অভিনয়শিল্পী, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিকদের নিয়েও আমাদের কাজ করার ইচ্ছা আছে।
 
কলকাতা সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
জেএইচ/জেডএস

** জমে উঠেছে বাংলাদেশ বিজয় উৎসব
** বিজয় দিবসের কাকভোরে কলকাতার পথে পথে
** নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে এক টুকরো বাংলাদেশ
**কলকাতায় শুরু হলো বাংলাদেশ বিজয় উৎসব
** ‘মমতার অন্তরের একদিকে পশ্চিমবঙ্গ অন্যদিকে বাংলাদেশ’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।