জাবি: নির্বিচারে ঝোপঝাড় পরিষ্কারের কারণে আর সব প্রাণী ও পতঙ্গের মতো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসের প্রজাপতিকূলও। দেশের মোট তিনশ’ প্রজাতির মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ১০২টিরই নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত এই ক্যাম্পাস এখন যেন প্রজাপতি হননেরই ফাঁদ হয়ে উঠেছে।
পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশে একে তো আবাস হারাচ্ছে নিরীহ প্রজাপতি, তারওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক প্রজনন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পক্ষ থেকে বিকল্প প্রজননের মাধ্যমে প্রকৃতির এই অলঙ্কার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও প্রশাসনিক জটিলতা ও অসহযোগিতার কারণে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত তিন বছর ধরে আয়োজন করে আসা প্রজাপতি মেলার ধারবাহিকতা আগামীতে রক্ষা করা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দানা বেঁধেছে। বস্তুত প্রজাপতি সংরক্ষণের গুরুত্ব ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতির ভূমিকা সম্পর্কে নানাভাবে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশেই এ মেলা আয়োজন করা হচ্ছিলো। কিন্তু প্রজাপতি সঙ্কটের কারণে আগামীতে এমন মেলা আয়োজন সম্ভব নাও হতে পারে।
প্রজাপতি মেলার আহ্বায়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ মো. মনোয়ার হোসেন তুহিন এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে বাংলানিউজকে বলেন, “গত ৩ বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতির নতুন কোন প্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। তাই অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ”
তিনি জানান, বাংলাদেশের বান্দরবান, উখিয়া, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি বনগুলোতে প্রজাপতির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া সিলেটের লাওয়াছড়া, সুন্দরবন ও মধুপুর ভাওয়াল গড়সহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রচুর প্রজাপতির দেখা মেলে। মধুপুর গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ প্রজাপতি পাওয়া যায় এবং বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া প্রজাপতির মধ্যে এক তৃতীয়াংশ প্রজাপতি পাওয়া যায় জাবি ক্যাম্পাসে।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃতির অন্যতম এই অলঙ্কার নিয়ে ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম কাজ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক মাহমুদুল আমিন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী। তখনই ঢাকা শহরে ২৭ প্রজাপতির প্রজাপতি চিহ্নিত করা হয়। এরপর ১৯৮৩-৮৫ সালে বিভিন্ন বনভূমিতে অন্য এক গবেষণায় ৩৩ প্রজাতির প্রজাপতি চিহ্নিত করা হয়।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনশ’ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শনাক্ত করা হয়েছে ১০২টি। এর মধ্যে ৬১ প্রজাতির প্রজাপতি ১৯৯৭-২০১০ সালে শনাক্ত করা হয়। এগুলোর মধ্যে মনোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধানে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন শিক্ষার্থী সহিদুজ্জামান ২১, আব্দুর রাজ্জাক ৩৬ ও মনোয়ার হোসেন নিজে চার প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করেন। ২০১০ সালে সর্বশেষ চার প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
জাবি ক্যাম্পাসে শনাক্তকরা প্রজাপতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘স্ট্রাইপড পাইরট’, ‘মানকি পাজল’, ‘ব্লু প্যানসি’, ‘পেইন্টেড লেডি’ ইত্যাদি। এছাড়া ‘গাউডি ব্যারণ’ ও ‘কমন ভেলবেট বব’সহ আরো কয়েক প্রজাতির প্রজাপতি বাংলাদেশে কেবল জাবি ক্যাম্পাসেই পাওয়া যায়।
কিন্তু ঝোপ পরিষ্কারের নামে এ ক্যম্পাসে বিদ্যমান প্রজাপতির প্রজনন, বৃদ্ধি ও জীবন ধারণে সহায়ক ‘কুমারী লতা’, ‘ঝুমকো লতা’ ও ‘আঙ্গুর লতা’র মতো গুল্ম নির্বিচারে ধ্বংস করায় প্রজাপতির চরম অস্তিত্ব সংকট তৈরি হয়েছে।
কেননা প্রজাপতি মূলত উদ্ভিদের পাতায় মধ্যে ডিম দেয় এবং সেখানেই ডিম ফুটে লার্ভায় পরিণত হয়। লার্ভাগুলো ওই গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
‘লার্ভা’ থেকে ‘পিউপা’য় পরিণত হওয়ার পর পিউপাগুলো ওই গাছের পাতার সঙ্গে ঝুলে থাকে। এভাবেই পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হয়। প্রজাপতির শতকরা ৫ ভাগ ডিম পরিণত হয় বাচ্চায়। প্রজাতি ভেদে এদের জীবচক্রেরও ভিন্নতা রয়েছে। তবে ক্যাম্পাসে কৃত্তিমভাবে প্রজনন ঘটিয়ে শতকরা ৩৬ ভাগ ডিম বাচ্চায় পরিণত করা সম্ভব হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে, পরিসংখ্যান ভবনের পেছনে, রসায়ন ভবনের দক্ষিণ পাশে ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনের বন-জঙ্গল ধ্বংস করার কারণে প্রজাপতির বাসস্থান ও খাদ্য হিসেবে তারা যে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ গ্রহণ করে তা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আবাসস্থল হারানোর পাশাপাশি খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে লার্ভা।
এই সঙ্কট কাটাতে ক্যাম্পাসের কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণার জন্য ২০০০ সালে ওয়াজেদ মিয়া গবেষণাগারের দক্ষিণ পাশের জায়গাটি বরাদ্দ দেয় প্রশাসন। পরবর্তীতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখানে ‘ব্রিডিং হাউজ’ বা ‘প্রজনন ঘর’ তৈরি করে প্রজাপতির গবেষণা ও কৃত্রিমভাবে প্রজনন ঘটিয়ে ক্যাম্পাসে অবমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা ও অসহযোগিতার কারণে ‘প্রজনন ঘর’টি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। এটি তৈরি করা গেলে কৃত্রিমভাবে প্রজনন ঘটিয়ে ক্যাম্পাসের প্রজাপতির সংখ্যা স্বাভাবিক রাখা যেত বলে মনে করেন প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, “ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বন বিভাগ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে কমিটি করা হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো বিশেষজ্ঞ থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বন বিভাগ থেকে কেন বিশেষজ্ঞ আনতে হবে এটা আমাদের বোধগম্য নয়। নীতিমালা প্রণয়নের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মনোয়ার হোসেন বলেন, “যে নীতিমালা প্রণয়ন হবে সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রশাসনের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রশাসনই ক্যাম্পাসের বন-জঙ্গল পরিষ্কার করছে, আবার তারাই নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলছে। ”
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসনের বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, গাড়ির ধোঁয়া ও ক্যাম্পাসে আগতদের অসচেতনতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় প্রজাপতির নতুন নতুন প্রজাতির সন্ধান মিললেও বাংলাদেশে এর সংখ্যা কমে যাওয়া উদ্বেগজনকই বটে।
বাংলাদেশে প্রজাপতির সবক’টি প্রজাতির তালিকা তৈরির পাশাপাশি এদের সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে বলেও মনে করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত প্রদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। এরইমধ্যে ক্যাম্পাসের কোনো জঙ্গল যেন কাটা না হয় যে জন্য নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের কাজ চলছে। এ কাজ শেষ হলে সবার সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থল রক্ষা সম্ভব হবে। ”
বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর/জেডএম