সিলেট: পাহাড়ি বন্ধুর পথ ধরে হাঁটছি আমরা ক’জন। হঠাৎ দূর থেকে কানে ভেসে এলো শোঁ শোঁ গম্ভীর শব্দ।
বাংলাদেশের কোল ঘেঁষে প্রতিবেশী ভারতের মেঘালয়ের গহীন অরণ্যের কোলে বাংলাদেশ পানে নেমেছে অপরূপ এক ঝরনাধারা। চোখ ধাঁধাঁনো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে রূপবতী এ ঝরনার আদুরে নাম লাগছে প্রতিদিন।
কেউ দেখে বলেন মায়া ঝরনা। কেউ অভিভূত হয়ে চিৎকার করে বলেন তার পছন্দের কোনো নাম। কারও নয়নে লাগছে ঘোর। আবার কেউ আনমনা প্রেমে ডুবে যেন হাবুডুবু খাচ্ছেন পাহাড়ের বুকচেরা এই প্রেমদাত্রী ঝরনার। তবে স্থানীয়রা কেউ কেউ একে ডাকেন বড়হিল ঝরনা বলেও।
একেবারে অপরিচিত এবং পর্যটকদের অজানা থাকায় এই রূপবতীর রূপ দর্শনে এখনও সেখানে ভিড় নেই। তাই প্রভাত সূর্যের কিরণে কিংবা বিকেলের গোধূলিতে ঘোমটা ছাড়াই অপরূপ মায়াজালে বাঁধে তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা! এই ঝরনা।
সীমান্ত নামের শক্ত দেওয়াল এই সৌন্দর্যকে আড়াল করতে পারেনি। রেডক্লিফ (১৯৪৭ সালে ভারত – পাকিস্তান সীমানা বিভক্ত করেন তিনি) ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু দৃষ্টির সীমানা তিনি নির্ধারণ করতে পারেন নি। তাই চোখ মেলে ধরে কিংবা ছোট নৌকায় চড়ে এই সুন্দরীকে ছোঁয়া না গেলেও কোল বেয়ে নামা জলরাশিকে স্পর্শ করা যায়। অবগাহন করা যায় এর সবুজ স্বচ্ছ জলে।
পাথরের স্নেহের এই ঝরনা ধারা পিয়াইন নদী ধরে ছুটে চলেছে বাংলাদেশের নদী-খাল-বিলে। ঝরনা তলে বৃষ্টির ফোঁটা যেন চুমকির লহরী হয়ে দুলছে। স্বচ্চ নীলাভ সবুজ জলের স্পর্শে সবুজ-শ্যামলিমায় ভরে উঠছে পানতুমাই গ্রামের মাঠ-প্রান্তর।
সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের প্রতাপুর সীমান্তে এই পানতুমাই গ্রাম। সুউচ্চ ঘেরা গ্রামটিও অদ্ভুত সুন্দর। পাহাড় ঘেঁষা আঁকাবাঁকা রাস্তা পানতুমাই গ্রামের বৈশিষ্ট্য। গ্রামের শেষে পাহাড়ি গুহা থেকে হরিণীর মতোই লীলায়িত উচ্ছল ভঙ্গিমায় ছুটে চলেছে সঠিক নাম না জানা এ ঝরনার জলরাশি। ছিটকে পড়ে মেলে ধরছের রূপের মাধুরী।
ঝরনার ছন্দে জলনৃত্যের তালে যেন বেজে চলেছে কাঁচের চুড়ির মধুর কিংকিনি ধ্বনি। পাহাড় পেরুবার প্রচণ্ড স্পর্ধা তার চোখে মুখে।
পানতুমাই ঘুরে ভ্রমণসঙ্গী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘গ্রিণ এক্সপ্লোর’-এর সভাপতি অনিমেষ ঘোষ তো বলেই ফেললেন, মানুষের অতিরিক্ত যাতায়াতে প্রকৃতি যেন তার রূপ হারিয়ে ভারসাম্যহীন না হয়। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কেননা পরিচিতি পাওয়ার পরই স্থানটিতে অনেকে যেতে চাইবে। আর এতে জাফলংসহ অন্যান্য পর্যটনে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মতো অপরিকল্পিত পর্যটন বিকাশ পেয়ে ধ্বংস হবে সবুজ প্রকৃতি।
আরও সঙ্গে থাকা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘প্রাধিকার’-এর সভাপতি রাহুল দাস তালুকদার ও জয় প্রকাশ রায় বলেন, দেশে একটি নতুন পর্যটন স্পট তৈরি হওয়া আমাদের জন্য সুখবর। তবে এতে যেন এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য ধ্বংস না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
যেভাবে যাবেন পানতুমাই
সিলেট থেকে তামাবিল মহাড়ক ধরে গাড়ি নিয়ে চল্লিশ মিনিটে প্রথমে যাবেন সারীঘাট বাজার। সেখান থেকে বাঁ দিক ধরে সারীঘাট-গোয়াইনঘাট লিংক রোডে আরও তিরিশ মিনিট পরেই পাবেন গোয়াইনঘাট সদরের প্রবেশমুখ। ডান দিকে গেলেই উপজেলা সদর আর বাম দিকের রাস্তা চলে গেছে সোনারহাট-প্রতাপপুর সীমান্ত ফাঁড়ির দিকে।
পানতুমাই যেতে হলে ছুটতে হবে এই পথে। গাড়িতে আরও ৩০ মিনিট। কিছুদূর গেলেই ঘিরে ধরবে পাহাড়। সহজেই বোঝা যায় গ্রাম পানতুমাই আর বেশি দূর নয়। তারপর আইড়কান্দি ব্রিজ হয়ে শেষে পাওয়া যাবে মাতুর তল বাজার। এই বাজার শেষে পানতুমাই গ্রামের প্রবেশপথ। এ পথ ধরে আরও ৫ মিনিট পরে গাড়ি পৌঁছে যাবে মায়াময় পানতুমাইয়ের কাছে। আরও কাছে যেতে হলে বাম দিকে নদীর কিনারে নামলেই পাবেন স্বর্গীয় ঝরনার ধারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৩
এসএ/সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর