ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

কপোতাক্ষ-খোলপেটুয়ার গ্রাসে ছোট হচ্ছে গাবুরা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৩
কপোতাক্ষ-খোলপেটুয়ার গ্রাসে ছোট হচ্ছে গাবুরা

Rafiqul2লেবুবুনিয়া, গাবুরা (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) ঘুরে এসে: ছোট হয়ে আসছে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। সুন্দরবনঘেঁষা কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর অব্যাহত ভাঙন হাজার হাজার মানুষকে করেছে নিঃস্ব।

নতুন বাঁধ দেওয়া হচ্ছে, আবার ভেঙে যাচ্ছে সে বাঁধ।

নিঃস্ব মানুষগুলো আশ্রয় নিচ্ছেন বাঁধের পাড়ে। জীবনযাপনের ন্যূনতম সুবিধা এখানে নেই। সরকারি সুবিধা পৌঁছায় সামান্যই। নির্বাচনের আগে এখানকার মানুষরা ভোট দিলেও ভোটের পরে জনপ্রতিনিধিদের দেখা মেলে না।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের এই ইউনিয়নটি উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন। একদিকে কপোতাক্ষ, অন্যদিকে খোলপেটুয়া বয়ে গেছে সুন্দরবনের দিকে। খোলপেটুয়া নদীর ওপারেই সুন্দরবন। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ ইউনিয়নের নানা সমস্যার মধ্যে নদীভাঙন এখানকার মানুষদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়।

upkulmভাঙনে নিঃস্ব একজন শহীদুল্লা গাজী। বাড়ি গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এখন নিঃস্ব। পরিবার পরিজনসহ বসবাস করেন বাঁধের ওপর। এক সময় ১৩ বিঘা জমি ছিল তার। সে জমিতে ছিল চিংড়ির ঘের। ভাইদের পরিবার মিলে ৩৫ জনের সংসার ভালোই চলতো এতে। এখন কাজকর্ম করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করেন।

শহীদুল্লাহ গাজী বলেন, বাঁধের ওপর বসবাস করতে নানা ধরনের সমস্যা হয়। বাঁধ ভেঙে গেলে কিংবা বাঁধ তৈরির সময় অন্যত্র চলে যেতে হয়। অসুখে পথ্য মেলে না। জরুরি স্বাস্থ্য সেবার জন্য খুলনার কয়রা কিংবা সাতক্ষীরার শ্যামনগর যেতে হয়। নদী পেরিয়ে সেখানে যেতে রয়েছে ঝুঁকি। নির্বাচনে ভোট দিলেও আমাদের জন্য সুবিধা মেলে সামান্যই।

লেবুবুনিয়ার বাসিন্দারা জানান, এখান থেকে শ্যামনগর যেতে হলে কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদী পার হতে হয়। দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। অন্যদিকে, কয়রা যেতে হলে কপোতাক্ষ পার হতে হয়। যেতে হয় প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ। মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে এলাকার মানুষ চরম বিপাকে পড়েন। আবার দুর্যোগের সময় তাদের সংকটের শেষ থাকে না। নেই সাইক্লোন সেন্টারও। ঝড়ের সংকেত পেলে ভয় হয়। জীবন বাঁচানোর কোনো উপায় থাকে না।

মহিবুল্লা গাজীর স্ত্রী নাহারুন বেগম জানান, বাড়িঘর নদীতে ভেঙে যাওয়ায় এই বাঁধের ওপর বাসা বানিয়ে থাকি। কাজ করে রোজগার হলে চাল কিনে ভাত খাই। রোজগার না হলে ধারকর্জ করে চলতে হয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে কখনো মাটির কাজ, কখনো ইটভাটায় কাজ করেন। এভাবেই কোনোমতে সংসার চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

গাবুরার নদীভাঙন এলাকা ঘুরে নিঃস্ব মানুষের সংকটের চিত্র চোখে পড়ে। এলাকায় ফসলি জমি কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে কাজের সুযোগ। চিংড়ি ঘেরে কাজ পায় সামান্য কিছু লোক। সুন্দরবনের কাজও আগের চেয়ে কমে এসেছে। জমিজমা নদীগর্ভে চলে যাওয়ার আগে ভাঙন কবলিতদের এতটা দুর্দিন ছিল না। এখন জীবিকার সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ মাসের পর মাস বেকার থাকে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, কাজের সন্ধানে এখানকার বহু মানুষ বাইরের শহরে যান। শীত মৌসুমে কাজ করতে যান ইটভাটায়। তারপরও তিনবেলা ভাত জোটানো সমস্যা হয়ে পড়ে। অনেকে দু’বেলা কিংবা একবেলা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। দুঃস্থদের জন্য সরকারি সাহায্য এখানে কমই আসে। সামান্য পরিমাণ বরাদ্দ এলেও তা সীমিত সংখ্যক মানুষ পায়। কেউ কেউ আবার এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন।

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়নের সাত হাজার ছয়শ’ পরিবারের মধ্যে অন্তত চার হাজার পরিবার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত। ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের গাগড়ামাটিয়া থেকে জালিয়াখালী খগেন বাবুর বাড়ি পর্যন্ত দশ কিলোমিটার কপোতাক্ষের ভাঙনের কবলে রয়েছে। নয় নম্বর ওয়ার্ডের নয় নম্বর সোরা গ্রাম থেকে দৃষ্টিনন্দন পর্যন্ত দুই কিলোমিটার খোলপেটুয়ার ভাঙনের শিকার। upkulmm

এছাড়া আট নম্বর ওয়ার্ডের চকবারা থেকে খোলপেটুয়া কালিবাড়ি মন্দির পর্যন্ত আট কিলোমিটার ও পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদনিমুখার গেট থেকে টেকেরহাটের মসজিদ পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার খোলপেটুয়া নদীতে ভাঙন রয়েছে।
 
ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নবীন্দ্রনাথ মন্ডল বাংলানিউজকে বলেন, নদীভাঙনে ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। ভাঙনরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যও নেই কোনো বরাদ্দ।    

এভাবেই আতঙ্ক, অভাব আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটছে সুন্দরবনঘেঁষা এই মানুষগুলোর।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।