ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

নির্মম পৈশাচিকতা: ওষুধেই কি লুকিয়ে আছে উন্মত্ততার বীজ!

ফিচার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৫১, এপ্রিল ৩, ২০১২
নির্মম পৈশাচিকতা: ওষুধেই কি লুকিয়ে আছে উন্মত্ততার বীজ!

খুনোখুনির খবর এখন আর দুর্লভ কোনও বিষয় নয়। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ এবং যৌক্তিক কোনও কারণ ছাড়া পাইকারি হত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি ঘটে গেছে।

ইউরোপ আমেরিকায় মাঝে-মধ্যেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে অবশ্য।

দেখা গেল বলা নেই, কওয়া নেই- হঠাও কেউ একজন রাইফেল বা বন্দুক হাতে রাস্তায় বের হয়ে বা কোনও মার্কেটে, স্কুলে বা নিজ কর্মক্ষেত্রে গিয়ে হঠাৎ গুলি করে নিরপরাধ মানুষ মারা শুরু করে দিল।

এসব ঘটনা মিডিয়ায় শিরোনাম হয়, এরপর সংশ্লিষ্ট শহর বা দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনী ব্যাপক তৎপর হয়ে অপরাধীকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে। তবে এসব ঘটনা খুব একটা ঘটে না বা বলা যায় বড় বড় বিরতিতে ঘটে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটে যা স্বভাবতই সচেতন মানুষকে ভাবিত করে তুলেছে। এসব ঘটনায় অকালেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে ঘুমের ঘোরে থাকা গ্রামের পুরো একটি পরিবারের, নিজ স্কুলের সামনে নিহত হয়েছে বিদ্যার্থী শিশু আর বিদ্যাদানকারী শিক্ষক। আপাত সাধারণ নির্বিরোধী মানুষগুলো হঠাৎ কিসের তাড়নায় বা প্রভাবে এমন মানসিকতায় চালিত হন যে নির্বিচারে এবং অকারণে নরহত্যা তাদের ‍বিবেকে অন্যায় কিছু বলে মনে হয় না!

অনেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে হয়ে পড়ছেন চরম জিঘাংসাতাড়িত, বিবেকের ঘরে তালা দিয়ে ঘটিয়ে ফেলছেন ভয়াবহ পৈশাচিক ঘটনা।

প্রশ্ন উঠেছে কি সে কারণ যা একজন মানুষকে হঠাৎ অমানুষ চণ্ডালে পরিণত করে? মাত্র কিছুদিন আগের ঘটনা। আফগানিস্তানে গভীর রাতে রবার্ট বেইলস নামে এক মার্কিন মেরিন সেনা তার আগ্নেয়াস্ত্রটি নিয়ে পাশের গ্রামে চলে গেল। উদ্দেশ্য- স্রেফ মানুষ শিকার। তার নির্বিচার গুলিতে একটি পরিবারের ১৭ জন বেঘোরে প্রাণ হারালো। ঘুমন্ত আর নিরস্ত্র ওই মানুষগুলোর মধ্যে ৯ জন ছিল শিশু। ভাবা যায়!

গত বছর নরওয়ের এক দ্বীপে ৩২ বছর বয়সী এক যুবকের হঠাৎ করে শুরু করা নির্বিচার গোলাগুলিতে কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে ২০ কিলোমটির দূরের ওই দ্বীপে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির ইয়থ ক্যাম্পের অনুষ্ঠান চলছিল। আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকা তরুণদের ওপর নরক গুলজার করে দেয় ওই নির্দয় বন্দুকধারী।

একই বছরের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের টুকসন এলাকার একটি পার্কিং লটের ঘটনা। এখানে একটি সাধারণ সভায় উপস্থিত ছিলেন ইউএস রিপ্রেজেন্টেটিভ গ্যাব্রিয়েল গিফ্ফোর্ড। জ্যার্ড লি লোফনার নামে এক ব্যক্তি হঠাৎ শুরু করে নির্বিচার গুলিবর্ষণ। এ ঘটনায় গ্যাব্রিয়েল ছাড়াও আরো ১৮ জন গুলিবিদ্ধ হন যাদের মধ্যে ৬ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন অ্যারিজোনা ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট চিফ জাজ জন রল এবং ক্রিস্টিনা টেলর গ্রিন নামের ৯ বছর বয়সী এক শিশু।

চলতি মাসে আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত ফ্রেঞ্চ নাগরিক মোহাম্মদ মিরাহ ফ্রান্সে পৃথক ঘটনায় ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। মিরাহ যাদের হত্যা করে তাদের সঙ্গে তার দূরতম কোনও সম্পর্কও ছিল না। তারপরেও বলা যায় কারণহীন কারণে তাদেরকে হত্যা করে সে। হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানোর সময়ে মিরাহ তার গলায় ঝোলানো একটি ভিডিও ক্যামেরায় তা ধারণ করে। মানসিক বিকারগ্রস্থতার চরম রূপ ফুটে ওঠে এসব ঘটনায়!

সম্প্রতি ফ্লোরিডায় ১৭ বছর বয়সী এক আফ্রো-আমেরিকানকে অকারণেই গুলি করে হত্যা করে স্পেনীয় বংশোদ্ভূত জর্জ জিমারম্যান। এ ঘটনায় দেশজুড়ে বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের  ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের অকল্যান্ড শহরে ওকোস নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি চালিয়ে সাত জনকে হত্যা করে এক উন্মত্ত বন্দুকধারী। এতে আহত হয় আরো চার জন।

পুলিশ জানিয়েছে, ৪৩ বছর বয়সী ওই খুনি ওয়ান গোহ কোরীয় বংশোদ্ভূত। অকল্যান্ড পুলিশের প্রধান হাওর্য়াড জর্দান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি চালানোর দায়ে অভিযুক্ত ওয়ান গোহ ওই প্রতিষ্ঠানেরই  সাবেক ছাত্র।

হত্যাকারী পরবর্তীতে ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী আলামেদা শহরের একটি সুপারমার্কেটের সামনে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ  করে।

কেন মানুষ হঠাৎ করে এমন বন্য হয়ে উঠছে? আদি অসভ্য মুণ্ডু শিকারীদের মনমানসিকতায় কেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে তারা অমন করে? খুব সহজেই এবং কোনও কারণ ছাড়াই নরহত্যা বা গণহত্যার মত ঘটনা কেন ঘটাচ্ছে এসব মানুষ! সবগুলো ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঘটনার শিকার ব্যক্তিরা খুনীদের পরিচিত ছিল না। তারা অজ্ঞাত-অপরিচিত ব্যক্তিদের গুলি করে হত্যা করেছে এবং খুনীরা কোনো অনুতাপ-অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। তারা এমনকি অযৌক্তিক পৈশাচিকতার এসব ঘটনাকে যৌক্তিক প্রমাণের চেষ্টাও চালায়!

এসব ঘটনার ক্ষেত্রে বলা যায়- আফগানিস্তানের গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালানো মার্কিন মেরিন স্টাফ সার্জেন্ট রবার্ট বেলস হয়তো পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার নামের রোগের ছুতোর আড়ালে নিজের ভয়াবহ অপরাধকে ঢেকে ফেলতে পারবে, তুলুসের খুনীও বেঁচে নেই (এক অভিযানে ফরাসি পুলিশ তাকে হত্যা করে), তবে বলা যায়- তারও হয়তো মেরিন সেনা বেলসের মত প্রচণ্ড মানসিক কোনো চাপ ছিল যা সেই বলতে পারতো, ফ্লোরিডার হত্যাকারী স্পেনীয় তাড়িত হয়েছে মনে গেঁথে থাকা যুক্তিহীন সংকীর্ণ চিন্তাধারা থেকে, যার ফলে সে কানটুপির মত মাথা ও ঘাড় ঢাকা বস্ত্র পরিহিত ওই আফ্রো-আমেরিকান কালো তরুণকে দেখে আতংকিত হয়ে যায় এটা ভেবে যে সে তাকে হত্যা করতে পারে। এবং এ কারণে জর্জ তাকে গুলি করে হত্যা করে। তবে উল্লেখিত এসব বয়ান থেকে বাস্তব হয় তো অনেক দূরেও হতে পারে।

বিভৎস, নারকীয় ওই হত্যাজজ্ঞগুলোর পেছনের কারণ হিসেবে চরম ক্রোধ, প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ, দিকভ্রান্ত বিশ্বাস, না বুঝে আত্মত্যাগী (শহীদ) হয়ে আলোচিত হওয়ার নেশা, ঘটনা ঘটানোর পর কয়েক মিনিটের মিডিয়া কাভারেজে আলোচিত হওয়ার সর্বনেশে লোভ- সবই আলোচিত হয়েছে। অপরাধীর পক্ষের জাদরেল উকিলরা মোয়াক্কেলকে বাঁচাতে অনেক ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন হলেও এসবকে শক্তিশালী ঢালে পরিণত করতে ভালোই পারেন। কিংবা দুর্বল কোনো রাষ্ট্রে গিয়ে এ ধরনের অপরাধ ঘটালে এবং অপরাধীর রাষ্ট্র প্রচণ্ড রকম শক্তিশালী হলে ওপরের যে কোনও প্রসঙ্গকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করা হতেই পারে। কিন্তু আসল কথা হলো এসবের পেছনের প্রকৃত কারণটা কি তাতে জানা যাচ্ছে?

ঠিক এই জায়গাটায় এসে এসবের পেছনের আরও একটি সম্ভাব্য কারণের কথা বলা হচ্ছে আজকাল। তবে বিষয়টি এখনও স্রেফ পর্যবেক্ষণের পর্যায়ে রয়েছে। চীনে ২০১০ সাল থেকে এ ধরনের ব্যক্তি আক্রমণের ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে যা দেশটির রাজনৈতিক-সামাজিক আবহের সঙ্গে বেশ বেমানানই। এ সূত্রে  রোগ সারাতে নেওয়া ঔষধের ক্ষতিকারক প্রভাবে এসব ঘটনার অবতারণা হচ্ছে কি না- এ প্রশ্নটি সামনে চলে আসে সেখানে। ধারণা করা হচ্ছে মানসিক বিষন্নতার প্রতিক্রিয়া লাঘব করার জন্য নেওয়া ঔষধntidepress (antidepressant) ntidepressant হয়তো ওইসব ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পেছনে ভূমিকা রাখছে। এ ধরনের ঐষধ সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। এসব ঔষধ মস্থিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যে ভয়াবহ বিচ্যুতি ঘটিয়ে বিভ্রমেরallucination (hallucinations) সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে- রোগ নিরাময়ে নেওয়া এসব ড্রাগের প্রভাবে আত্মঘাতী বা পরঘাতী- দুটো হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে গ্রহণকারীর।

যদি বিষয়টি এরকমই হয়ে থাকে যে মানুষের তাৎক্ষণিক ভয়াবহ উন্মত্ততার পেছনে বিষন্নতা বা মানসিক চাপ দূরকারী ঔষধের প্রভাব দায়ী- যা একজন সরলসিধা মানুষকে মুহূর্তেই মূর্তিমান পিশাচে রূপান্তরিত করতে পারে (ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড এর মত), সেক্ষেত্রে বলতে হবে- এ বিষয়টার প্রতিকার পেতে জোর গবেষণা শুরু করা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে ভারতে এক ব্যক্তি স্রেফ তার গাড়িতে সামান্য একটু দাগ ফেলে দেওয়ার অপরাধে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে এক ড্রাইভারকে খুন করে। এ ধরণের অসংখ্য ঘটনা ঘটেই চলেছে। মাস কয়েক আগে সেদেশেই এক ড্রাইভার অকারণে উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে।  

মানুষ বাড়ছে, উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে পৃথিবী। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবন যাপনের ব্যস্ততা আর জটিলতা। আশংকা করা অনভিপ্রেত হলেও অসমীচিন হবে না যে- এ ধরনের ঘটনা সামনে আরও ঘটতেই থাকবে এবং তা ঘটবে বেশি মাত্রায়।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় চলে আসে। হত্যাকারীরা প্রায় সবাই তরুণ-যুবক। সেলফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, আইপ্যাডের এ যুগে বিশ্ব তরুণ সমাজ (উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে) ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হয়ে পড়েছে- যেখানে তারা চায় অবসর এবং কাজেরও পুরো সময়টাই কাটিয়ে দিতে- সেখানে বাস্তবতা কি একবারও কড়া নেড়ে জিজ্ঞেস করে না- জীবনটাকে শুধু কল্পজগতের ইথার তরঙ্গে ভাসমান একটি খেলা হিসেবে নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক হচ্ছে? কারণ ভার্চুয়াল জগতে মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে কিন্তু এক পর্যায়ে আসে বিষন্নতা, অবসন্নতা, চমৎকার এ পৃথিবী সম্পর্কে মন হয়ে পড়ে নিষ্পৃহ। এরপর পরিত্রাণ খোঁজা হয় বিষন্নতা দূরকারী ঔষধে। সুতরাং কাজের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার তার বেশি ভার্চুয়াল ভ্রমণ কি খুব বেশি প্রয়োজন!  

এই প্রশ্নের উত্তর ভার্চুয়াল জগতে ভাসমান তরুণ সমাজের জন্য খুব জরুরি এখন।
সূত্র: খালিজ টাইম্স

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৯ ঘণ্টা, ০৩ এপ্রিল, ২০১২

সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।