ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম, ডুমনি ঘাট। যেখানে শুধুই বসবাস আদিবাসীদের।
তাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের কাহিনী শোনার যেনও কেউ নেই। মহাজন ও ভূমিগ্রাসীদের রাহুগ্রাসে তাদের সমৃদ্ধ অতীত হারিয়ে আজ তারা নিঃস্ব।
কালের বিবর্তনে ডুমনি ঘাটের আদিবাসীরা বংশ পরাম্পরায় ধাবিত হয়েছে অনিশ্চিত আর্থিক অবস্থা আর অবক্ষয়ের পথে। তাদের ইতিহাস যেন অধঃপতনের ইতিহাস। অধিকারহীনতার ইতিহাস। তাদের দুর্ভাগ্যজনক ভাগ্য যেন তারা আজ নিজেরাই রচনা করে চলেছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে ডাকাতিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ও দুর্গম গ্রাম ডুমনি ঘাটের দুর্দশার করুণ চিত্র চোখে পড়ে।
শাল গজারী বনাবৃত, খাল আর নালায় ঘেরা ছোট গ্রাম। অচেনা পথচারীকে গ্রামটির দৃষ্টি নন্দনসবুজ ছায়াময় রূপ হাতছানি দিয়ে ডাকে। বর্ষায় এটেল কাঁদামাটির মেঠো পথ-বন্ধুর-দুর্গম হলেও মায়াবী আকর্ষণ নিয়ে আহ্বান জানায় বাইরে থেকে আসা মানুষকে।
বর্ষাকালে উপজেলা সদর থেকে সড়ক পথে বিচ্ছিন্ন থাকা গ্রামটিতে যেতে হয় নদী পথে।
ভালুকা থেকে ক্ষীরু নদীতে নৌকা করে যেতে হয় মল্লিকবাড়ির বাজার। তারপর এবড়ো-থেবড়ো মেঠোপথে ৬ কিলোমিটার পরেই ডুমনি ঘাট।
এ গ্রামে অসংখ্য বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন অথচ একজনও বয়স্ক ভাতা পান না। গ্রামটিতে মধ্যবিত্তের সংখ্যা হাতেগুনা মাত্র কয়েকজন। চরম দরিদ্র সীমায় বসবাস করে এ এলাকার মানুষ।
এ গ্রামের ছোট শিশু অনীল (৯) জীবন সম্পর্কে যার কোনো ধারণা হওয়ার আগেই সে জেনে গেছে তার আত্মপরিচয়। ধনীর সংজ্ঞা না বুঝেই নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে,‘আমরা তো গরীব মানুষ। ’
এ গ্রামে ভিজিএফ কার্ডের বরাদ্ধ রয়েছে মাত্র ১টি। আর সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি হলেন এলাকার নরেন্দ্র দফাদার।
প্রায় শতাধিক পরিবারের এ আদিবাসী গ্রামে গরীব মানুষদের জন্য সরকারি সাহায্য সহযোগিতার আকাল চলছে বছরের পর বছর। এ বৈষম্য বঞ্চনার কোনো সমাধান টানতে পারেন না যেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। যেন অদৃশ্য কোনো নিয়মে বাঁধা রয়েছে তাদের কর্মকাণ্ড।
জানালেন, তাদের সমস্যা হলো বরাদ্ধ সংকট। যদিও মূল সমস্যা সদিচ্ছার। আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি এবং তাদের সমস্যার গভীরে পৌঁছার মতো দূরদৃষ্টিহীন জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি প্রশাসনের সামনে এজেন্ডাভূক্ত করতে পারেন না। তাই এ এলাকায় চলছে এ দুরাবস্থা।
ডুমনি ঘাটের আদিবাসী রাজবংশী বর্মন (৪৫) বাংলানিউজকে জানান, এলাকার একশ’ পরিবারের মধ্যে শারদীয় দুর্গোৎসব করার মতো অবস্থা কারো নেই।
সম্মিলিতভাবে পূজা করার মতো অবস্থাও নেই। ফলে দুর্গাপূজায় প্রতিমা দর্শন করতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাইকে যেতে হয় ৫ কিলোমিটার দূরে মল্লিকবাড়ি বাজারে।
এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগই ছোট ছোট কুড়ে ঘর। দুয়েকটি টিনের ঘর ডুমনি ঘাটের অভাবী ল্যান্ডস্ক্যাপ। একদিন যে পরিবার প্রচুর জমি জমার মালিক ছিল সেই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম, উত্তরাধিকাররা এখন অনেকে ভূমিহীন।
এ গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ অমূল্য বর্মণ (৮৭)। যার বাবার ছিল ৪২ একর জমি। এক জীবনেই অমূল্য বাবুর পৈত্রিক সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেছে। মৃত্যুর আগে তিনি তার সন্তানের জন্য রেখে যাচ্ছেন শুধু ভিটেমাটি।
৫০ বছরে ৪২ একর জমির মালিক আজ ভূমিহীন । বিচিত্র এ বিপর্যয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে অমূল্য নিজ মুখে জানালেন, জমির মূল্য পেয়েছেন পানির দরে। সুদখোর মহাজনরা ছদ্মবেশে ভূমিদস্যু হয়ে তার সম্পত্তি গ্রাস করেছে।
অমূল্য বাবু বলেন, ‘বাপদাদার জমি জিরাত মাইনসে নিয়া গেছে গা। পাঁচ টেকা কর্জ নিছি আর তার সুদ আসলে জমি দিছি ৫ কাঠা। না দিলে মহাজন মাইরা ফেল তো। জানের ডরে জমি দিয়া মইররা গিয়া বাইচ্চা আছিরে বাপু। ’
অমূল্য বাবু জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে এখনো সেই ভূমিগ্রাসীদের নাম বলতে সাহস পান না।
স্থানীয় অনেকে জানিয়েছেন, সুদখোর মহাজন, ভূমিদস্যুরা যেমন ভালুকার আদিবাসীদের সম্পত্তি গ্রাস করে বনভূমি দখল করছে তেমনি বন বিভাগের লোকেরাও মামলা নিয়ে আদিবাসীদের সর্বস্বান্ত করার পথে ঠেলে দিয়েছে। ডুমনি ঘাটের আদিবাসী গ্রামের ৩১ জনের ঘাড়ে ঝুলছে বন মামলা।
মাসে মাসে ময়মনসিংহের আদালতে হাজিরা দিতে দিতে ওরা ক্লান্ত। মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে চড়া সুদে টাকা ঋণ করতে হয়। রিকশা কিংবা ভ্যান চালিয়ে কষ্টার্জিত টাকা ঢালতে হয় আদালতের আঙিনায়।
বনদস্যু আর ভুমি দস্যুরা বনাঞ্চল উজাড় করে দখলদার সেজে বহাল তবিয়তে রয়েছে অথচ গরীব এ আদিবাসীরা বন মামলায় আসামি হিসেবে ফেরারি জীবন কাটাচ্ছে চরম উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তায়।
আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভাব অনটন, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণার নানা কথা কাহিনী শোনা যায়। শত শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এ বনাঞ্চলে চলছে তাদের ঘরসংসার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা গরীব থেকে শুধুই গরীবতর হচ্ছে। মানবেতর জীবন যাত্রায় তারা খেয়ে পরে বাঁচার সংগ্রামে লিপ্ত। জীবনযুদ্ধে ক্রমাগত পরাজয় গ্রামটিকে দুর্গত এলাকা করে রেখেছে।
সরেজমিনে ডুমনি ঘাটের বিভিন্ন দোকানে দেখা গেছে, ভরদুপুরে পুরুষ মানুষ অলস সময় কাটাচ্ছে। কেউবা খেলছে তাস, কেউবা আবার ঠেলা গাড়িতে শুয়ে বিশ্রাম করছে। অথচ অদূরেই ভিন্নরূপ। মহিলারা গলদঘর্ম হয়ে ঘরে বাইরে কাজ করছে।
আদিবাসী নারীদের কেউ কেউ ক্ষেতে নিড়ানী দিচ্ছে। কেউ বা ধান রোপণ বা অন্য কৃষি কাজে ব্যস্ত। প্রভাতী বর্মন (৪৫) বলেন, ‘এ গ্রামে পুরুষরা দিন মজুরী করে ঠেলাগাড়ি চালায়। আর সংসার চালাতে মাইয়া মানুষরা হাতের কাজ করে। এখানে ঘরে ঘরে রয়েছে হস্তশিল্প। ’
ডুমনি ঘাটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের চিত্রও হতাশাব্যঞ্জক। চিকিৎসা ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই।
১৯৯৬ সালে এ গ্রামে একটি ফিডার স্কুল চালু হয়। সরকারি স্কুল নেই। হবিরবাড়ি ক্যাথলিক মিশনের ফাদার তনিজুর সহযোগিতায় ধরনীকান্ত বর্মনের প্রচেষ্টায় ওই স্কুলটি চালু হয়।
পড়ানো হয় ক্লাশ থ্রি পর্যন্ত। এ স্কুলে জয়দেব বর্মন (৩২) ও ধরনী বর্মন (২৮) মিশনের অনুদানের সামান্য বেতনে শিক্ষকতা করেন। তারা জানান, ‘শিশুরা অক্ষরজ্ঞান অর্জন করছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষার পথ অনিশ্চিত। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১২
প্রতিবেদক: এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
সম্পাদনা: মো. মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর/ আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর