ঢাকা: সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গ অংশের বিচ্ছিন্ন জনপদ সন্দেশখালি। দু’ঘণ্টার সড়ক পথ তারপর নৌকা, এরপর পৌঁছানো যাবে সন্দেশখালিতে।
ভারতের লোকসভায় গত মাসে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় ফি বছর নিখোঁজ হওয়া মানুষের ব্যাপারে। হারিয়ে যাওয়া মানুষের পরিসংখ্যান এ সময় তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক বছরে শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকেই ১৪ হাজার প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হারিয়ে গেছে। এদের অধিকাংশই অবৈধ মানবপাচার বাণিজ্যের করাল গ্রাসে পরিণত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এখন পরিণত হয়েছে পাচারকারীদের জন্য মানুষ শিকারের লোভনীয় ক্ষেত্র। সরকারি তথ্য অনুযায়ী শুধু পশ্চিমঙ্গেই গত বছর নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ৮ হাজার মেয়েশিশু, আর সাড়ে পাঁচ হাজার পুরুষ।
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত সন্দেশখালির মতো গ্রামগুলি হয়ে উঠছে মানব পাচারকারীদের কাঁচামাল সংগ্রহের ঊর্বর ক্ষেত্র। গত দশ বছরে প্রকৃতপক্ষে এই গ্রামের প্রত্যেক পরিবার থেকে কেউ না কেউ পাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়েছে। এখানকার প্রায় প্রত্যেক মা তাদের হারিয়ে যাওয়া কন্যার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় থাকে।
২০০৯ সালের আইলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই সন্দেশখালী গ্রাম। অনিবার্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ এমনিতেই এ এলাকার মানুষকে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করে রাখে, তার ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে আগ্রাসী অভাব-দারিদ্র। নিত্য অভাবী হতদরিদ্র মানুষগুলো অর্থের প্রলোভনে পাচারকারীদের জালে ধরা পড়ে তাই খুব সহজেই।
সামান্য ক’টা টাকার প্রলোভনে দালালদের মিষ্টি কথায় ভুলে গ্রাম থেকে অনেক দূরের শহরে নিজেদের ছেলেমেয়ে পাঠাতে তাই দ্বিধা করে না তারা।
সন্দেশখালির এমনই এক মায়ের সঙ্গে কথা হয় একটি গণমাধ্যম প্রতিবেদকের। এই মা প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন তার হারিয়ে যাওয়া ১৬ বছর বয়সী কন্যার জন্য। ছয় বছর আগে তার সেই মেয়েকে হায়দরাবাদ শহরে ভালো কাজ দেওয়ার আশা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় পরিবারকে প্রতি মাসে বেতন পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দালালেরা। কিন্তু সেই শেষ। এরপর আর কখনো মেয়ের মুখটি দেখেননি তারা।
দুর্গা পূজা যায়, কালী পূজা যায়, বছরের পর বছর পার হয়, কিন্তু তাদের প্রতীক্ষার পালা আর শেষ হয় না। বছর কেটে যায়, কিন্তু তাদের মেয়ে আর ফিরে আসে না। নিজের জীর্ণ ছোট্ট কুটিরে বসে নিজের কাহিনী প্রতিবেদককে বলছিলেন সন্তানহারা এই মা।
এই মায়ের চার সন্তান, যার দু’টিই মেয়ে। পরিবারের মাসিক আয় ১ হাজার রুপিরও কম। তাই পরবর্তী সময়েও যখন দালাল এসে সামান্য কিছু টাকার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তার কোনো সন্তানকে চাইবে তখন হয়ত আরেকটি সন্তানকে তুলে দেওয়ার হাত থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারবেন না এই তিনি।
ভারতে পাচারকারীদের শক্তিশালী চক্র এ ধরনের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও সক্রিয় থাকে। সন্দেশখালিতে পাচারচক্রের হোতার নাম হরি। সে মূলত টার্গেট করা পরিবার ও শহরে যে চক্রটি এই মেয়েদের নিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে, তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে কাজ করে।
এ ব্যাপারে জানতে হরির মুখোমুখি হলে প্রতিবেদকদের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠে সে। এমনকি ক্যামেরাও ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
হরি মূলত কাছাকাছি শহরের পাচারচক্রের কাছে এই মেয়েদের নিয়ে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে চূড়ান্তভাবে বড় কোনো শহরে পৌঁছার আগে বেশ কয়েকবার হাত বদল হয় এই মেয়েগুলো। বড় শহরে পৌঁছার পর যে মেয়েগুলো পতিতালয়ে বিক্রির জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয় না তাদের স্থান হয় গৃহকর্মী হিসেবে শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে। দালালেরা গৃহকর্মী সরবরাহের বিপরীতে নিয়োগকর্তাদের থেকে মাসিক ভিত্তিতে বেতনও আদায় করে থাকে।
স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের এসব সহজ সরল অশিক্ষিত মেয়ের বাড়ি থেকে বহুদূরে অচেনা আজব শহরে কোনো সাহায্য পাওয়ার জায়গা থাকে না। ফলে খুব অল্প অংশই শেষ পর্যন্ত বাড়ির ঠিকানা ফিরে পায়। বাকিরা হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।
সূত্র: বিদেশি সংবাদমাধ্যম
বাংলাদেশ সময়: ২১১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১২
সম্পাদনা: ওবায়দুল্লাহ সনি, নিউজরুম এডিটর; জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর/ মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর