ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

শুধু চাকরির জন্য শিক্ষা নয়: রবিনসন

বাবু আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:২০, এপ্রিল ৫, ২০১২
শুধু চাকরির জন্য শিক্ষা নয়: রবিনসন

স্যার কেন রবিনসন শিক্ষাখাতে উন্নতির জন্য দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছেন। যিনি শিক্ষাকে উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীলতা হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

রবিনসন পৃথিবী বিখ্যাত একজন বক্তা। কেন রবিনসন ২০০৬ সালে টেডএক্স সম্মেলনে চমৎকার বক্তৃতা দেন। যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা চাকরি পাওয়ার জন্য করা হয়েছে। যা মোটেও ঠিক নয়। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।

স্বপ্নযাত্রার পাঠকদের জন্য টেডএক্স সম্মেলনে দেওয়া স্যার রবিনসনের বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুবাদ করে দেওয়া হলো।    

আজকের আলোচনা তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে চলছে। আমি যা যা বলতে চাই তার সঙ্গে এই বিষয়গুলোর সম্পর্ক রয়েছে।
একটি হলো এখানে তোমাদের সবার ভেতরই সৃজনশীলতা আছে। এই সৃজনশীলতা নিয়েই আমি কথা বলতে চাই।

শিক্ষার ব্যাপারে আমার সবসময়ই আগ্রহ আছে। সত্যি কথা বলতে, আমি সবার মধ্যেই এই আগ্রহটা খুঁজে পাই। শিক্ষা বিষয়টাই অনেক আগ্রহের! তাই না?

আমাদের পড়ালেখা নিয়ে এতো আগ্রহের কারণ হচ্ছে এই পড়ালেখাই আমাদের এমন এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যায় যা আমরা চিন্তাও করতে পারি না।

একটু ভেবে দেখো, এই বছরে যেসব শিশুরা স্কুলে যাওয়া শুরু করবে তারা ২০৬৫ সালে অবসর নেবে। কিন্তু তারপরও আমরা কেউ জানি না আগামী পাঁচ বছর পর এ পৃথিবীর অবস্থাটা কি হবে!

আমি মনে করি প্রতিটি শিশুর মধ্যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা আছে। আমি মনে করি সব বাচ্চারাই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। যদিও আমরা তাদের ভাবনাগুলোকে অনভিজ্ঞ বলে উড়িয়ে দেই। তাই আমি শিক্ষা সম্পর্কে এবং সৃজনশীলতা সম্পর্কে বলতে চাই। আমি বলতে চাই সৃজনশীলতাও স্বাক্ষরতার মতই গুরুত্বপুর্ণ।  

কয়েকদিন আগে একটা গল্প শুনেছিলাম। যা আমি এখন প্রায়ই নানা জায়গায় বলি। ছয় বছরের এক মেয়ে ড্রয়িং ক্লাস করছে। ক্লাসের শিক্ষক দেখতে পেলেন মেয়েটি ক্লাসে একদমই মনোযোগ দিচ্ছে না। শিক্ষক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি করছো? মেয়েটি বলল, আমি ঈশ্বরের ছবি আঁকছি। শিক্ষক অবাক হয়ে বলল, কিন্তু কেউই ঈশ্বরকে দেখেনি; এমনকি তুমিও না। মেয়েটির জবাব ছিল, হুম, কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই দেখতে পাবে।

শিশুদের তাদের সুযোগগুলো দিতে হবে। যদি বাচ্চারা না শেখে কোন কাজ কিভাবে করতে হবে; তবে তাদের ঝরে পড়তে হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে শুরুতে ভুল করার ব্যাপারে ওরা একদমই ভয় পায় না। আমি বলছি না ভুল করা এবং সৃজনশীলতা একই জিনিস। কিন্তু যদি ভুল করার ব্যাপারে প্রস্তুত না থাকি তাহলে কখনোই আমাদের মধ্যে আসল অনুভূতি জেগে উঠবে না।
ভুল যদি না করে কিংবা যদি শিশুদের ভুল করতে না দেওয়া হয় তবে বড় হয়ে তাদের সৃজনশীলতার শক্তি হারিয়ে ফেলে। বড় হয়েও ভুল করার ব্যাপারে ভয় পায়। ভয়ের জন্য কোনো কাজেই মন দিতে পারে না।  

আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এই পদ্ধতি দেখতে পাই। কোথাও ভুল করলে ক্ষমা নেই। ভুল করলেই চাকরি যাবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও আমরা নির্ভুল করে চালাতে চাই। শিক্ষার বিষয়ে ভুল করা মহা অপরাধের সমান।

এর ফলে অনেক বড় একটি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত হয় ঠিকই; কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় তার সৃজনশীলতা। পিকাসো বলেছিলেন, প্রতিটি শিশুই একজন শিল্পী। কিন্তু ওই শিশু বেড়ে উঠার সময়েই সেই শিল্পী সত্ত্বাটি অকেজো হয়ে পড়ে।

তোমরা যখন যুক্তরাষ্ট্র যাবে তখনই এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিন্নতা চোখে পড়বে। পৃথিবীর সব শিক্ষা ব্যবস্থাতেই অংক এবং ভাষা শিক্ষা থাকে। তারপর গুরুত্ব দেওয়া হয় শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ে।

পৃথিবীর সব জায়গাতে একই অবস্থা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগীত, নাটক এবং নৃত্যের থেকে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয় বিজ্ঞান, অংক, ভাষা ইত্যাদি বিষয়কে। পৃথিবীর কোথাও এমন কোন শিক্ষক নেই যিনি শিক্ষার্থীদের নেচে দেখান। কিন্তু কেন? আমি মনে করি অংক যেমন গুরুত্বপুর্ণ; ঠিক তেমনি নাচও গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদেরকে অনুমতি দিলে তারা সবসময়ই নাচতে থাকে। কতো সুন্দর লাগে তখন!

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের অধ্যাপক বানানোর জন্যই তৈরি হয়েছে।

এমনকি আমি নিজেও অধ্যাপকদের পছন্দ করি। শিক্ষকদের নিয়ে আমার নিজের একটা মতামত আছে। তারা সবসময় নিজেদের মধ্যেই বসবাস করে। সেটাও একটা নিজস্ব পরিবেশে। তারা নিজেদের শরীরকে তাদের মাথা বহনের জন্য ব্যবহার করেন।
এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। কারণ ছিলো ১৯ শতকের আগে পৃথিবীর কোথাও  সার্বজনীন শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিলো না। তখন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা মেটাতেই এই ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

ফলে একটা বাচ্চা যা পছন্দ করে তাকে সেই বিষয়গুলো থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। যেমন তাদেরকে গান শিখতে মানা করা হয় কারণ কারো বাবা মা চায় না তাদের সন্তান সংগীত শিল্পী হোক। তাদের ছবি আঁকতে মানা করা হয় কারণ সমাজ চায় না কেউ চিত্রশিল্পী হোক।

প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা যা আমাদের চিন্তাভাবনার গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। ফলে অত্যন্ত প্রতিভাবান, সৃজনশীল ব্যক্তিরা আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। তাদের ভাবনার গতি বন্ধ হয়ে যায়। একসময় হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে  তারা নিজেদেরকে সমাজের মধ্যে অকেজো ভাবতে শুরু করে।

তাই, আমি মনে করি না আমাদের এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

ইউনেস্কোর হিসেব অনুযায়ী আগামী ৩০ বছরে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মানুষ স্নাতক সম্মান অর্জন করবে। এতে কী লাভটা হবে? এই শিক্ষিত মানুষগুলোকে দেখা যাবে বাসায় বসে ভিডিওগেমস খেলছে। কারণ বাজারে চাকরি নেই।

এসবের মাধ্যমেই শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বসে যাচ্ছে। এখন আসলেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আবার চিন্তা ভাবনার সময় এসে গেছে। চাকরির জন্য শিক্ষা মোটেও হওয়া উচিত নয় বলে আমি মনে করি।

আমি একটা বই নিয়ে কাজ করছি। বইটির নাম “যীশুর আবির্ভাব” যার মধ্যে আমি বিভিন্ন মানুষের প্রতিভা নিয়ে কয়েকটি সাক্ষাৎকার নিয়েছি। সেখানে গিলিয়ান নামে এক নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে আমার কথা হয়। তাকে প্রশ্ন করি, কিভাবে নৃত্যশিল্পী হলেন? উত্তরে সে আমাকে মজার গল্প শোনায়।

গিলিয়ান তার বাবা-মাকে নৃত্যশিল্পী হওয়ার ইচ্ছা জানায়। বাবা মা বিচলিত হয়ে ভাবতে থাকে গিলিয়ানের মধ্যে লার্নিং ডিজঅর্ডার আছে। তাই সে নৃত্যশিল্পী হতে চাচ্ছে।

গিলিয়ানকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। তার মা ডাক্তারকে সব সমস্যার কথা বলেন। ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। পরে গিলিয়ানকে বাইরে যেতে বলেন। গিলিয়ান বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে ডাক্তার একটি গান ছেড়ে দেন।  

এরপর গিলিয়ানের দিকে দুজনই তাকিয়ে থাকেন। ডাক্তার এবং গিলিয়ানের মা দুজনই বিস্ময়ের চোখে গিলিয়ানের নাচ দেখতে থাকেন। ডাক্তার তার মাকে বলেন, গিলিয়ান মোটেও অসুস্থ নয়। সে একজন শিল্পী। তাকে মিউজিক স্কুলে নিয়ে যান।

এরপরের কাহিনী বলার সময় গিলিয়ানকে স্মৃতিকাতর দেখায়। সে বলতে থাকে, আমাকে মিউজিক স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কেউই তার নিজের জায়গায় স্থির থাকে না। সবাই নাচে, গান গায়,আঁকছে। সবাই সবকিছুই করে।

এখন আমি মনে করি আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নতুন একটি হিউম্যান ইকোলজিকে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এই প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। যদিও আমরা হয়তো ভবিষ্যতকে দেখবো না কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে। তাই সেভাবেই আমাদের সৃজনশীলতাকে লালন-পালন এবং চর্চা করতে হবে। হয়তো এভাবেই একদিন পৃথিবী নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি পাবে। ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১২

সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।