ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘ভাঙা ঘরে চাঁদের ‍আলো’ শিশু ফুটবলার রমজান

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৪৬, এপ্রিল ৫, ২০১২
‘ভাঙা ঘরে চাঁদের ‍আলো’ শিশু ফুটবলার রমজান

ঢাকা : পরিবারের কঠোর দারিদ্র আর নানা প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি কিশোর রমযানকে তার লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার পথে। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর নিয়মিত অনুশীলন তাকে পৌঁছে দিয়েছে লক্ষ হাসিলের সোপানে।



সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার সেক্টর ৪-এ স্থানীয় কল্যাণ সমিতির মাঠে অনুষ্ঠিত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ-কিডস ক্লাব ফুটবল টুর্নামেন্টে অভূতপূর্ব ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখায় রমযান। একই সঙ্গে ‘প্লেয়ার অব দি টুর্নামেন্ট’ ও ‘স্কোরার অব দি টুর্নামেন্ট’ পুরস্কার লাভ করে সে।

এসব পুরস্কার ছাড়াও টুর্নামেন্টের স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রমযান ও তার পরিবারের জন্য রীতিমত দুর্লভ এক সুযোগ করে দেয়া হয়, যা আজন্ম দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এ পরিবারের কাছে অবিশ্বাস্য এক আনন্দের অনুসঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে!

স্পন্সর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পক্ষ থেকে বাবা-মা’র সঙ্গে রমযানের নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু ভ্রমণের যাবতীয় ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর মধ্যে, ঢাকা-কাঠমুন্ডু-ঢাকা আসা যাওয়ার টিকিট, কাঠমুন্ডুতে থাকা-খাওয়া ও ভ্রমণের সকল খরচ, ভিসা ও পাসপোর্ট তৈরির খরচ, ভাল পোশাক প্রদান ছাড়াও হাত খরচের জন্য নগদ অর্থও দেয়া হবে।

রমযানের বাবা আব্দুল আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, ‘অভাবের সংসারে ঠিক মত পুলারে খাওয়াইতেও পারি নাই।   দিন আনি দিন খাইয়া ক্যামনে ভাবমু আমার পুলা এত বড় পুরস্কার পাইবো। ’

রমযানের বড়ভাই আক্কাস মিয়া বলেন, ‘এত আনন্দ জীবনে পাই নাই। খুশিতে চিনা সব লোকেরে মিষ্টি খাওয়াইছি। আমার ভাই আরো বড় অউক-এ্যাডাই চাই। ’

ফুটবল খেলে অল্প বয়সেই বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ, ভবিষ্যতে কেমন খেলোয়াড় হতে চাও- এমন প্রশ্নের উত্তরে রমযান বলে, ‘আমি মেসির খুব ভক্ত। বড় হয়ে তার মতো খেলোয়াড় হতে চাই। ’
 

পেছনের গল্প
কিশোরগঞ্জ সদরের দরিদ্র ভ্যানচালক আব্দুল আজিজ। মফস্বল শহরে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরেও ঠিকমত সংসার চলছিল না তার।

একটু ভাল রোজগারের আশায় আব্দুল আজিজ প্রায় ১ যুগ আগে পুরো পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। রাজধানীর উত্তরার মধ্য আজমপুরে ফরিদমার্কেট এলাকায় ছোট পরিসরের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে নতুন করে শুরু করেন জীবন সংগ্রাম। দারিদ্রের কারণে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করাতে না পেরে ছোট ছেলে রমযানকেই শুধু পড়ালেখা কাতে থাকেন।

উত্তরার আজমপুর এলাকায় বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত হোপ অব চিল্ড্রেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় রমযানকে। বর্তমানে রমযান ওই স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র।

খেলাধূলার প্রতি রমযানের আগ্রহ শৈশব থেকেই। হালকা ছিপছিপে গড়নের রমযান মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে সারাক্ষণ ফুটবল খেলায় মত্ত থাকে। পড়াশুনাতেও ফাঁকি দেয় না। পরিবারের সদস্যরা সেজন্য তার খেলাধূলায় বেশি একটা বাধ সাধেনি।

স্বচ্ছলপরিবারের ছেলেমেয়েদের মতো রমযানের সুযোগ হয়নি কোনো ক্রীড়া প্রশিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়ার, মেলেনি পর্যাপ্ত খেলার উপকরণও। অভাবের সংসারে খেয়ে-পড়ে থাকাটাই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে রমযানের স্বাদ-আহ্লাদ পূরণের সুযোগই বা কোথায়!

এরপরও এলাকায় দুরন্ত কিশোর ফুটবলার রমযানের জয়জয়কার। প্রতিপক্ষকে গোল দেয়ার ক্ষেত্রে তার যেন বিকল্প নেই দলে।

যেভাবে স্বপ্ন পূরণের পথে
রাজধানীর অভিজাত স্কলাস্টিকা স্কুলের উত্তরা ক্যাম্পাসের ক্রীড়া শিক্ষক ও উত্তরা কিডস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ফিরোজ আহমেদ। তিনি অনুভব করেন রাজধানীর অধিকাংশ ছেলেমেয়ে খেলাধূলা না করার কারণে যথাযথ শারীরিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলে আগামী প্রজন্ম অনেকটা শারিরীকভাবে অক্ষম হয়ে বেড়ে ওঠছে।

এ অনুভব থেকে তিনি শিশুতোষ ক্লাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। এ প্রসঙ্গে ফিরোজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাজধানীর স্কুলগুলোর বেশির ভাগই খেলার মাঠহীন। এ কারণে শিশুরা খেলাধূলা করতে পারে না। তাদের ঘরের মধ্যে একরকম বন্দি জীবনে বেড়ে ওঠতে হয়। এসব শিশুদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের জন্য একটি শিশুতোষ ক্রীড়া ক্লাব গঠনের চিন্তা করি। ’

তিনি বলেন, ‘প্রথমে অভিজাত পরিবারের শিশুদের নিয়ে এটি করার পরিকল্পনা করলেও পরে সাংবাদিক নুরুল কবিরের (নিউএজ সম্পাদক) পরামর্শে এর সাথে বস্তির ছিন্নমূল পরিবারের শিশুদেরকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিই। এর ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উত্তরা কিডস ক্লাব নামে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়।

বর্তমানে ছিন্নমূল ও অভিজাত পরিবারের শিশু মিলে কিডস ক্লাবের সদস্য ২৪ জন। উত্তরার সেক্টর ৪ এর কল্যাণ সমিতির অনুমতি নিয়ে তাদের মাঠ ও খেলাধূলার সময়ে সমিতির একটি কক্ষ ব্যবহার করে সংগঠনটি।  

শুরু থেকেই রাজধানীর অভিজাত কয়েকটি স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষকরা এ উদ্যোগে আমাকে সহায়তা দেন। কিডস ক্লাবের শিশুদের যাতে মূলধারার খেলাধূলার চর্চায় যুক্ত করা যায়, সে লক্ষ নিয়ে অনেক দিন থেকে একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টা করে আসছিলাম। এর অংশ হিসেবে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সহায়তায় গত ৩১ মার্চ মিনি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় কিডস ক্লাব রেড টিম ও সানিডেল স্কুল অংশ নেয়। এতে ছিন্নমূল শিশুদের রেড টিম বিজয়ী হয়। খেলার পুরোটা সময় জুড়েই বস্তির অনগ্রসর পরিবারের শিশুদের ক্রীড়া নৈপুণ্যে মাঠ সরগরম ছিল। ’

রমযানের প্রসঙ্গে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘খেলাধূলার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ও পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কিডস ক্লাবের সদস্য করি। টুর্নামেন্টে সে এত ভাল খেলবে তা পূর্বে ধারণা ছিল না।

তবে রমযানের এ সাফল্য আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছে। আমার বিশ্বাস সে একদিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও খেলার সুযোগ পাবে। ’

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব.) তাজবিরুল আহমেদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘অভিজাত পরিবারের শিশুদের সাথে ছিন্নমূল শিশুদের প্রতিযোগীতার বিষয়টি আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছে। দরিদ্র শিশুদের মাঝেও মেধা রয়েছে- এই প্রতিযোগীতা আবারো একথা প্রমাণ করেছে। ’

তিনি আরো বলেন, ‘পুরস্কার ও বিদেশ ভ্রমণের সুযোগই নয়, আমার প্রতিষ্ঠান এখন থেকে রমযানের পড়াশুনার সব ব্যয় বহন করবে। ’

ছিন্নমূল শিশুদের পড়াশুনা ও মেধাভিত্তিক প্রতিযোগীতায় পৃষ্টপোষকতার জন্য অন্যদের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়ঃ ১৯৩২ ঘন্টা, এপ্রিল ৫, ২০১২
এআই
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।