ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সুচিত্রা সেনের ৮২তম জন্মদিনে পাবনায় নানা আয়োজন

আশরাফুল ইসলাম ও শাহীন রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:০৫, এপ্রিল ৬, ২০১২
সুচিত্রা সেনের ৮২তম জন্মদিনে পাবনায় নানা আয়োজন

পাবনা: আজ ৬ এপ্রিল, ভারত উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি সুচিত্রা সেনের ৮২তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তার জন্মস্থান পাবনায় নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে সুচিত্রা সেন ভক্তরা।



অপরদিকে, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও সুচিত্রা সেনের শৈশব স্মৃতি বিজড়িত পাবনার পৈত্রিক ভিটা আইনি জটিলতায় দখলমুক্ত না হওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে ভক্ত ও সাংস্কৃতিককর্মীদের মাঝে।

জন্মদিনে তাই আবারো দাবি উঠেছে, সকল আইনি জটিলতা দ্রুত নিরসন করে বাড়িটি উদ্ধার করে এটিকে ‘সুচিত্রা সংগ্রহশালায়’ রুপান্তর করা হোক।

এদিকে, সুচিত্রা সেনের ৮২তম জন্মদিন উদযাপনের অংশ হিসেবে পাবনার সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ ও পাবনা প্রেসক্লাব পৃথক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক কামাল সিদ্দিকী বাংলানিউজকে জানান, সুচিত্রার জন্মদিন পালন উপলক্ষে সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শুক্রবার দুপুরে আলোচনা সভা ও কেক কাটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।

একইদিন সন্ধ্যায় পাবনা প্রেসক্লাবও কেক কেটে উদযাপন করবে সুচিত্রা সেনের জন্মদিন।  
 
দখলের ইতিবৃত্ত ও স্থানীয়দের আকুতি : স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সুচিত্রা সেনের বাড়ি দখলমুক্ত করে সংগ্রহশালা কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান করার জন্য ২০০৮ সালে থেকে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. এ এফ এম মনজুর কাদির বাড়িটির একসনা লিজ বাতিল করে এটিকে দর্শনার্থীদের জন্য অবমুক্ত করার উদ্যোগ নেন।

কিন্তু বাড়িটির দখলকারীরা হাইকোর্টে আপিল করলে হাইকোর্ট লিজ বাতিলের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ দেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ২৬ জুলাই সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়িটি সাতদিনের মধ্যে সরকারের দখলে নেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই বাড়ি দখল ও আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি।

ওই আদেশের পর সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়ি দখল করে গড়ে ওঠা ইমাম গাজ্জালী ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল জামায়াত নেতা  আইয়ুব হোসেন খান একই বছরের ২৭ জুলাই স্থগিতাদেশের জন্য আপিল করেন।  

৪ আগস্ট সাতদিনের মধ্যে সরকারের দখলে নেবার হাইকোর্টের সেই আদেশ দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।  

পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগ থেকে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়িয়ে বাড়িটি এখনও নিজেদের দখলে রেখেছে দখলদার চক্রটি। ফলে এখন পর্যন্ত হয়নি দখলমুক্ত হয়নি বাড়িটি।

পাবনা জেলা পরিষদের প্রশাসক ও সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি এম সাইদুল হক চুন্নু বাংলানিউজকে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় আমাদের পক্ষে আছে। কিন্তু দখলকারীরা সুপ্রিমকোর্টে রিট করার পর পূর্ণাঙ্গ রায়টা এখনও আমরা হাতে পাইনি। `

তিনি জানান, অল্পদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি। এটি পাওয়া গেলেই আইনি জটিলতা নিরসন করে বাড়িটি দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে।  

জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুচিত্রা সেনের বাড়ি দখলকারীরা হাইকোর্টের রায়ের উপর করা আপিলের ওপর শুনানি চলছে। আদেশ দেবার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাবনা শহরের পৌর এলাকার গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতের জীবন্ত কিংবদন্তী নায়িকা সূচিত্রা সেন। বাবা-মা, এক ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে রমা সেনের (পরবর্তীতে সুচিত্রা সেন নামে পরিচিতি পান) শৈশব-কৈশোর কেটেছে হেমসাগর লেনের বাড়িতেই।

পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর পারিবারিক প্রয়োজনে সুচিত্রা সেন কলকাতা চলে যান।

পরবর্তীতে পাবনা জেলা প্রশাসন উর্ধতন সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক ভিটা অধিগ্রহণ করে। এরপর থেকে বাড়িটিতে সরকারি কর্মকর্তারা বসবাস করতে থাকেন।

১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের সময়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. সাইদুর রহমানের সহযোগিতায় জামায়াত নেতা আব্দুস সুবহানসহ অন্যরা কৌশলে বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত করে একসনা লিজ নেয়। তারপর এখানে ইমাম গাজ্জালী ইনস্টিটিউট নামের একটি কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে চক্রটি। এ সময় বাড়িটির অনেক মূল্যবান ফলজ ও বনজ বৃক্ষ কেটে বাড়ির সবুজ বেষ্টনী উজার করে দেয় দখলকারীরা।

এরই মধ্যে বাড়িটির স্থাপত্য শৈলীর মূল অবকাঠামো পরিবর্তন করে বাড়িটির ছাদের অধিকাংশ ভেঙ্গে ফেলে ঢেউটিনের চালা দিয়ে তাদের প্রয়োজন মত ঘর তৈরি করা হয়।
 
পাবনাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২২ জুন পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ইমাম গাজ্জালী ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের একসনা লিজ বাতিল করে ৮ জুলাই ২০০৯ এর মধ্যে অর্পিত সম্পত্তির দখল ছেড়ে দেওয়ার জন্য নোটিশ দেয়।  

পাবনা প্রেসক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও কবি ছিফাত রহমান সনম বাংলানিউজকে বলেন, উপমহাদেশের কিংবদন্তি নায়িকার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র বেদখল করে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করার নীল নকশা করছে, আমরা বাড়িটি মুক্ত দেখতে চাই।

একুশে বইমেলা উদযাপন পরিষদ পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কমরেড জাকির হোসেন ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পাবনার সভাপতি গণেশ দাস একই রকম দাবি জানিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুচিত্রা সেনের বাড়িটি আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদ বেদখল হয়ে আছে-এটা আমাদের জন্য লজ্জার। অবিলম্বে বাড়িটিকে দখলমুক্ত করে আর্কাইভে রূপান্তর করা হোক। ’

এখনো উজ্জ্বল শৈশবস্মৃতি:
বর্তমানে নিভৃত জীবনযাপন করা বাংলা চলচ্চিত্রের  সর্বকালের জনপ্রিয়তম নায়িকা সুচিত্রা সেন বা স্বজন-অনুরাগীদের প্রিয় রমাদির কাছে এখনো উজ্জ্বল শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি।

বিভিন্ন সূত্রমতে, বাংলা চলচ্চিত্রের এই জীবন্ত কিংবদন্তি পাবনার কথা মনে করে আকুল হয়ে ওঠেন।  

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েকজন বাঙালিকে রমাদি বলেছিলেন, পাবনায় তার অনেক স্মৃতি রয়েছে। পরবর্তী কোনো এক সময়ে পাবনায় আসার আগ্রহও ব্যক্ত করেছিলেন তিনি।  

এদিকে, ২০০১ সালে বাড়িটি দেখতে এসেছিলেন সুচিত্রার পিসতুত ভাইবোন সুজাতা সেনগুপ্ত, পরমা সেনগুপ্ত, অলক সেনগুপ্ত, দিলিপ সেনগুপ্ত। পাবনা এসে তারা বলেন, ‘রমাদির জন্মগৃহে এসে আমরাও ধন্য। ’

উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালে `শেষ কোথায়` ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় সুচিত্রা সেনের।

পরবর্তী বছরে উত্তম কুমারের বিপরীতে `সাড়ে চুয়াত্তর` ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। ছবিটি বক্স-অফিসে দ‍ারুণ সাফল্য পায়। বাংলা ছবির এই অবিসংবাদিত জুটি পরবর্তী ২ যুগ ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। আজো সেই খরবেগ জনপ্রিয়তায় এতোটুকু ভাটা পড়ে নি।    

১৯৫৫ সালে দেবদাস ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন, যা ছিল তার প্রথম হিন্দি ছবি। উত্তম কুমারের সঙ্গে বাংলা ছবিতে রোমান্টিকতা সৃষ্টি করার জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে খ্যাতিমান অভিনেত্রী।

১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকে তার অভিনীত ছবি মুক্তি পেয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পরও তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন, যেমন হিন্দি ছবি `আন্ধি`। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বলা হয় যে চরিত্রটির প্রেরণা এসেছে ইন্দিরা গান্ধী থেকে। এই ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নেন। এর পর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে নয়াদিল্লী যাওয়ায় আপত্তি জানানোর কারণে তাকে পুরস্কার দেওয়া হয় নি। তার মেয়ে মুনমুন সেন এবং নাতনী রিয়া সেন ও রাইমা সেনও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

সুচিত্রা সেন ৫৩টি বাংলা এবং অন্য ভাষার ৭টি ছবিতে অভিনয় করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১২
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।