ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পিজির-বটতলা`য় মায়ের স্নেহ

ইকবাল জাফর খন্দকার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:১৯, এপ্রিল ৭, ২০১২
পিজির-বটতলা`য় মায়ের স্নেহ

রাত তখন সাড়ে ৮টা। প্রায় দিনের মতো আজিজ সুপার মার্কেটের আড্ডা শেষে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছি।

আমাদের ভাষায় স্থানটির নাম `পিজির-বটতলা`। এখানেই আমাদের দিন-শেষের আড্ডা।

পেশা-নেশা (শিল্প-সাহিত্য ও মিডিয়ার ভিন্ন-ভিন্ন আঙ্গিকে ঝোঁক অর্থে) আর বয়স-অভিজ্ঞতার বিচিত্রতাই সেই মাহফিলের অন্যতম সৌন্দর্য। ‘অনিমন্ত্রিত অথচ প্রত্যাশিত’ সভ্যদের দুÕচারজন কেবল এসে পৌঁছেছি। সেটা সমস্যা নয়। কারণ আমরা হয়তো পিপীলিকা দিয়ে শুরু করব। কিন্তু একসময় তা জমে উঠবে, লোকও বাড়বে। এবং সহসাই আমরা পিপীলিকা ছাড়িয়ে ‘উত্তেজিত হস্তি’র অস্তিত্বই টের পাব।

তবে আজ সে পর্যায়ে যাবার আগেই এক ভদ্রমহিলার চিৎকার ছন্দপতন ঘটালো। ত্রিশোর্ধ্ব মধ্যবৃত্ত বেশভূষার এক ভদ্রমহিলা কাঁদছেন আর উন্মাদের মতো দিকবিদিক ছুটে চলেছেন। ডেকে চলেছেন ৬ বছর বয়সী সন্তানের নাম ধরে। আমি এগিয়ে গেলাম। জানলাম, বারডেমে এক নিকটাত্মীয়কে দেখতে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা। কিছু ফল-ফলারী কিনতে তার রাস্তার এপাড়ে আসা। সাথে ছিল সন্তান। একসময় তিনি দেখেন তার শাড়ি-ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চটি লাপাত্তা...।

কিন্তু আমি আর বেশিদূর এগুতে পারলাম না। পেছন থেকে টান পড়ল। আমার এক `সিনিয়র ফ্রেন্ড` ফিরে আসতে ইঙ্গিত করলেন। বটতলার দিকে ফিরে যাবার পথে বললেন, ‘এত ঔসুক্য দেখিয়ে লাভ নেই। দেখ, মহিলা কোনো কাহিনী করে এসে এ কান্না দেখাচ্ছে। ` আমি দুর্বলস্বরে বললাম, `সে তো ছেলেটির মা...`

তিনি বললেন, `দেখলে না ক`দিন আগেই তো ঢাকা মেডিকেলে এমনই এক মা তার সন্তানকে প্রেমিক দিয়ে ঘাড় মটকিয়ে মেরে মিডিয়ার সামনে সেকি কান্না কাঁদল! এখন এসব অহরহ হচ্ছে...”

এরপর যথারীতি আড্ডা শুরু হল, একসময় জমেও উঠল। কিন্তু আমি আর তাতে মনোনিবেশ করতে পারলাম না। দুটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। এক- ‘কাহিনী’? কী সহজেই একজন মাকে সন্দেহ করে বসা হল! দুইÑ এই সন্দেহকে স্পষ্টস্বরে নিন্দাও কেন করা গেল না?

আসলে আমাদের সমাজটা বুঝি খুব বদলে গেছে? খুব বেশি নয়, বছর বিশেক আগেও কি কোনো মা তার সন্তানের খুনি হতে পারে এমন সন্দেহ চট করে কারো মাথায় আসত? ‘মা’ শব্দটির ভাবমূর্তি আমাদের মনোরাজ্যে যে আলোড়ন তোলে সেখানে সন্তান-হন্তারকের কুৎসিত রূপ কখনো কোনোভাবে সামান্যতম প্রশ্রয় পায় কি? আমাদের সমাজ-সভ্যতা-কালচার-দেশ-ধর্ম মাকে দিয়েছে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও ভক্তিময় অবস্থান। সে অবস্থান সর্ম্পকে কি নবপ্রজন্মের মায়েরা কি সচেতন? সচেষ্ট কি তারা ধরে রাখতে মাতৃত্বের সেই গৌরবকে?

যান্ত্রিক সভ্যতা আমাদেরকে দৈহিক সুখ-সমৃদ্ধি ঢের দিয়েছে এবং দিয়েই চলেছে। ফলে, ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক বৈভবের অধিকারীদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থাটা দিনকে দিন আরও জমকালো হয়েছে। নানা দরকারি-বেদরকারি প্রযুক্তি-পণ্যের যৎকিঞ্চিৎ ছোঁয়ায় মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরাও হয়েছে শিহরিত। কিন্তু এইসব প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, সচেতনতা এবং সমাজজীবনে এর কুপ্রভাব সম্পর্কে আমাদের ঔদাসীন্য যে খুবই পষ্ট।

অর্থাৎ একদিকে যন্ত্র ও প্রযুক্তিগত সভ্যতার বিকাশ ক্রমধাবমান। অপরদিকে হৃদয়বৃত্তিক বা মনোবৃত্তিক সভ্যতার অচর্চা, অনিবেশ ও উৎকর্ষ সাধনের প্রয়োজনীয় সচেতনতার বিপরীতে অনিরীক্ষিত-অযাচিত ব্যক্তিস্বার্থগত চিন্তা-লোভ ও ভোগের প্রত্যাশাকে প্রশ্রয়Ñ মানুষ হিসেবে আমাদের উচ্চতায় স্পষ্টরূপে আঘাত হানছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে আমাদের সকল অর্জন ও গৌরবের সকল সৌধ।

এই বাংলাদেশে আজ আমাদের যাদের বয়স পঁচিশোর্ধ্ব, তাদের ক’জনের মা-ই উচ্চশিক্ষিত বা শিক্ষিত। এবং তাদের সন্তানদের স্নেহ-মমতায়-আদরে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা কতটুকুই বা প্রযুক্তি-মিডিয়া বা তথাকথিত ‘দেশ উদ্ধারকারী’ নানা সংস্থার উৎসাহ, সচেতনতা বা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন? অথবা আদৌ কেউ কি পেয়েছেন? আদৌ কি তাদের তা প্রয়োজন পড়েছে?
অথচ তাতে কি মায়া-মমতায়-যতে শিশুপালনে কোনো ঘাটতি পড়েছে? তাহলে তাদের ওই শিক্ষা, ওই প্রেরণা, ওই সচেতনতা, ওই দায়িত্ববোধ এবং ওই মমতার অনুভূতিকে কে উসকে দিয়েছিল? Ñনিশ্চয় তা উসকে দিয়েছিল তাদের পরিবার-সমাজ-দেশ-ধর্ম ও কালচারগত শিক্ষা, নৈতিক চেতনা, ও সামাজিক বিধি-নিষেধের সূত্রে গড়ে ওঠা ‘সচেতন বিবেক’।

বর্তমানের আবহে মিডিয়া ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এবং বিভিন্ন সংস্থার উৎসাহ, সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের এই দিনে উল্লিখিত বিষয়গুলি যেন গুরুত্বহীন ‘সেকেলে’ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। ফলে নতুন প্রজন্মের মায়েদের ভেতর থেকে বারবার পুত্রহন্তারকের অভিযোগে আয়েশা, হুমায়রা, রোজিনা বেগমদের মতো মা’দের ঠিকই পাচ্ছি। কিন্তু সেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের ভোতা চেতনার দ্বারে টোকা দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না।

এইতো গেল একদিক। অন্যদিকে ভ্রুণহত্যা, নবজাতক শিশু হত্যা তো আজ ভয়াবহ আকারে দাঁড়িয়েছে। পেপার-পত্রিকায় প্রত্যহ আসতে আসতে আজ সে খবরগুলি বোধহয় গুরুত্বহীন ‘প্রাত্যহিক বিষয়’ এর তালিকায় গিয়ে ঠেকেছে। ফলে প্রিন্ট বা অন্যান্য মিডিয়ার অনেক কর্তাব্যক্তির মতে- যত্রতত্র পড়ে থাকা অবস্থায় মৃত নবজাতকের খবর ‘নিউজ ভেল্যু’ হারিয়েছে। জীবিত উদ্ধার হলে হয়তো বড়জোর একটা উল্লেখযোগ্য নিউজ বা স্টোরি হতে পারে। দুঃখ ও লজ্জার বিষয় প্রতিবছর এই অজস্র ভূমিষ্ঠতব্য বা সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুদের মানবাধিকার নিয়ে কারও উচ্চ-বাচ্য নেই। কারো কোনো মাথাব্যথাও যেন নেই। উপরোন্তু বিষয়ে অনেকের ভাবখানা এমন যে, এটা সভ্যতার অনিবার্য ফসল!

আজ কথায় কথায় যারা পরিবারকে, সমাজকে ধর্মকে ভাঙ্গতে চান, বিভেদ দেখে উল্লসিত হন, তাদের কাছে এই ক্রাইসিসগুলির কারণ বোধগম্য না হবারই কথা। অথবা তা গুরুত্বহীন ব্যাপার বা জেগে ঘুমানোই তাদের নিয়ত।

কেননা তারা কেবল নিজেরই ফায়দায় ভেতরের বর্বরতাকে অতি-আধুনিকতার আপ্তবাক্যে-মুখোশে লুকিয়ে চাতুর্য্যের সঙ্গে নিজেকেই বাহবা দিয়ে যাচ্ছে। বৈপরীত্যপূর্ণ অদ্ভুত খায়েসে অনেকেই ধর্ম ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী সেজেও নিজেকে ‘প্রতিষ্ঠিত’ দেখতে চান বা চাচ্ছেন। এবং পাইক-পেয়াদা, গুণগ্রাহী-চাটুকার সৃষ্টি করে এমন এক আবহ সৃষ্টি করছেন যেন তিনিই যুগের ‘অবতার’ বা মহামান্য পথপ্রদর্শক! অতএব, এইসব আত্মপূজারী, ব্যক্তিপূজারী ও তাদের চেলা-চামুণ্ডা তথা আত্মাবন্ধক-দানকারী দাস-অনুদাসদের স্বীকার-অস্বীকার আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। কেননা মানবসমাজের কল্যাণে তাদের ভূমিকা সব কালে সব যুগেই শূন্যের কোঠায়। তারা তাদের কথা, তাদের প্রভূদের শেখানো বুলি এবং লোভ ও হীনম্মন্যতায় গড়া এক অবিন্যস্ত ভোগের জীবনের বাইরে যেতে প্রস্তুতও নয়।

অতএব, ভাবতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সাধারণকে, ‘সহজ-মানুষ’কে। দুষ্টক্ষতগুলি, অবক্ষয়গুলি, ডালপালা মেলে ধরা কুসংস্কারগুলির অবসানে এই ‘নগণ্য’ আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে, লড়তে হবে জেনে বুঝেই।

যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। পরে জেনেছি ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। জাতীয় জাদুঘরের কাছে এক কোণায় সে একা দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। ছেলেটি তার মাকে জানায়, ‘একটা আঙ্কেল’ তাকে নিয়ে এসেছে। শীতের রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও আতঙ্কে জমতে চলা শিশুটি তখন এর বেশি কিছু বলতে পারেনি। মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কেবলই কেঁদেছে।
আমি তো আমার মাকে দেখেছি, আজও দেখছি। তাঁর স্নেহ-জিজ্ঞাসা ও মমতার কাছে আমি বারংবার শিশু হয়ে যাই। যখন আমি তাঁর থেকে দূরেÑ তাঁর মানিক-বাপ ডাক, তাঁর কণ্ঠস্বর, নিজেকে হাজারো কষ্টে রেখে সন্তানের প্রতি তাঁর শুভ কামনা আমাকে সকল অবস্থায় আপ্লুত করে, ভাসিয়ে দেয় মাতৃত্বের মাহাত্ম্যের সমুদ্রে।

আজকের এই প্রজন্মে এমন হাজারো লাখো মা আছেন যারা আমার মায়ের মতোই মাতৃত্বের ওই মহান আসনে আসীন। তাঁদেরকে কোনোভাবেই ছোট করা যায় না, আর সে হীন প্রচেষ্টাও আমাদের থাকতে পারে না। শুধু বলতে চাওয়া, আজ যে গুটি-কয়েক তথাকথিত মা তার সন্তানের আশ্রয়স্থল নিজের আঁচলকে সন্তানের গলার ফাঁস করে তুলেছেন তা মাতৃত্বের অবমাননা, মানবতার অবমাননা।

ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার পূজারী, পরকীয়া-অনৈতিকতা ও ভোগবিলাসে বিভোর মানুষের কাছে এটা কোনো সমস্যা না মনে হলেও Ñ সঙ্গতই ধরে নিতে হবে এই ক্ষয়রোগ প্রতিরোধ বা নিরোধ করা না গেলে একদিন এ সমাজজীবন, এ মানবজীবনকে তা গ্রাস করে ফেলবে।

তখন আমাদের নতুন প্রজন্মের আদমেরা পাবে এমন এক জীবন যেখানে নৈতিকতা, মানবিকতা, প্রেম, আবেগ তথা হৃদয়বৃত্তিক সকল বিষয় বে কার্যত অবলুপ্ত। তাকে কি বলবÑ পশু জীবন? দুঃখিত, পশু-পাখিও যে অনুভূতি সম্পন্ন। তবে কি বলব রোবট? লজ্জিত, রোবট কি নিজ ইচ্ছায় কারও ক্ষতি করতে পারে?

লেখক: সহকারী সম্পাদক, সমন্বয়কারী ও সহ-সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রণয়ন প্রকল্প

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৭ ঘণ্টা, ০৭ এপ্রিল, ২০১২

সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।