ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘মোবারকঘোনা আবাসন’ যেন এক নির্বাসন

মু. রিগান উদ্দিন, মিরসরাই প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১৪, এপ্রিল ৮, ২০১২
‘মোবারকঘোনা আবাসন’ যেন এক নির্বাসন

মিরসরাই (চট্টগ্রাম): চারদিকে অথৈই পানি। জনবসতি থেকে দূরে ফেনী নদীর বুকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ।



মৌলিক অধিকার বঞ্চিত একদল অসহায় মানুষের বসবাস সেখানে। নেই বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। বর্তমান যুগে বসবাস করেও ওরা যেন আদিম যুগের মানুষ; নির্বাসিত কোনো জনগোষ্ঠী।

এই চিত্র মিরসরাইয়ের মোবারকঘোনা আবাসন প্রকল্পের। ১৯৮৪ সালের দিকে ফেনী নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে বাস্তবায়ন করা হয় ‘মোবারকঘোনা আবাসন প্রকল্প’।

এখানে কোলাহল যেমন নেই; নেই যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো সহজ মাধ্যম। তবুও সেখানে বাস করছে দু’শটির বেশি পরিবার। যাতায়াতের সু-ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের এই প্রকল্পে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টারও বেশি।

৪ নম্বর ধূম ইউনিয়নের বাংলাবাজার থেকে পশ্চিম দিকের সড়ক ধরে হাঁটা শুরু করলে ৩ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে যাওয়া যাবে ফেনী নদীর এই দ্বীপে।

সরেজমিনে দ্বীপে গিয়ে দেখা যায় কাজল বেগম, শাহজাহান বেগম, আনোয়ারা বেগম ও আয়শা আক্তারদের মত ভিটেমাটিহারা অসহায় একদল মানুষের দুর্বিষহ দিনযাপনের চিত্র।

জানা গেছে, ২০০৭ সালে সরকারের উদ্যোগে মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ২০০ ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য উপজেলার ৪ নম্বর ধূম ইউনিয়নের মোবারকঘোনা আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

জেলা পরিষদের ত্বত্তাবধানে এ প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয় উপজেলার প্রায় ২০০ পরিবারকে। স্থানীয়ভাবে এই প্রকল্পের দেখাশুনার দায়িত্বে আছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। কিন্তু প্রকল্পের বাসিন্দারা জানালেন, ২০০৭ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর  থেকে এ পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তার দেখা পাননি তারা।

প্রকল্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৭ সালে ১০টি সেটে ২০০ পরিবারকে পুনর্বাসন, তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও আইনশৃঙ্খলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রকল্পের যাত্রা শুরু।

বাস্তবতা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে ১০০ পরিবারকে স্থায়ীভাবে বাসস্থানের বন্দোবস্ত এবং বাকি ১০০ পরিবারকে অস্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়া প্রকল্প ও প্রকল্পের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য আর কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।

প্রকল্পের ‘স্বপ্না’ সেটের বাসিন্দা নূরুল হক বাংলানিউজকে জানান, সরকার এখানে ৮০টি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ করলেও অব্যবস্থাপনার কারণে এর মধ্য থেকে ৪৫টি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য স্থাপিত ২২ টি নলকূপের সবগুলিই নষ্ট।

‘প্রচেষ্টা’ সেটের বাসিন্দা বেলাল হোসেন (২৮) জানান, এখানে পুনর্বাসনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করায় প্রতিটি পরিবার দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে।

শাহেদা আক্তার (২৫) বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকার শুধু থাকার জায়গা দিয়েছে। আমাদের জীবন-যাপনের আর কোনো ব্যবস্থা এখানে রাখেনি। ’ 

একই সেটের বাসিন্দা কাজল বেগম জানান, তারা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো রকম সহায়তা পান না। ৫ কিলোমিটার হেঁটে ৪ নম্বর ধূম ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের কাছে সহায়তার জন্য গেলে তারা এই এলাকার ভোটার নয় বলে চেয়ারম্যান তাদের কোনো সহায়তা করবেন না বলে জানান।

প্রকল্পের বাসিন্দা শাহজাহান বেগম জানান, তার ৩টি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তান। স্বামী বেলাল হোসেন গাড়িচালক। তার অভিযোগ, স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের পাড়ায় কোনো রকম সেবা দিতে আসে না। তার একটি সন্তানকেও পোলিও বা অন্য কোনা টিকা খাওয়ানো হয়নি।

বাসিন্দারা জানান, সরকার তাদের সবার জন্য একটি মৎস্য প্রকল্প (পুকুর) ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু পাড়ার দালাল প্রকৃতির লোকদের কারসাজিতে এটা নিজেদের জিম্মায় রাখা যায়নি। অন্যের কাছে বর্গা দেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে কথা বললে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তারেক ইসমত জামসেদি বলেন, ‘এ প্রকল্পের দেখাশুনার দায়িত্ব ইউএনও’র। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো সাহায্য-সহায়তার ব্যাপারে আমাকে ইউএনও কিছু বলেননি। ’

ইউএনও আশরাফ হোসেনের কাছে প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের বাসিন্দা বা সংশ্লিষ্ট কেউ তাদের সমস্যার কথা আমাদের জানায়নি। ’

তবে তিনি খোঁজ খবর নিয়ে প্রকল্পবাসীর সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দেন।

বাংলাদেশ সময় : ১৪৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১২

সম্পাদনা : রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর/ আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।