ঢাকা : ভারতীয় গুপ্তচর মেহবুব এলাহি খবরটায় বেশ আনন্দিত হন যে তার জেলজীবনের সঙ্গী পাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ভারত সফরে এসেছেন। তিনি চেয়েছিলেন, সাবেক কারাসঙ্গী জারদারির সঙ্গে মোলাকাত করতে।
১৯৮৬-৮৭ সালে করাচির একটি জেলে কয়েকমাসের কারবাসকালে জারদারিকে সঙ্গী হিসেবে পান এলাহি। এলাহীর আশা, যদি পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার সাক্ষাতের সুযোগ হয়, তিনি তাকে অনুরোধ করবেন- পাকিস্তানের কারগারগুলোতে দণ্ডভোগরত সব ভারতীয় যুদ্ধবন্দিকে মুক্ত করে দিতে।
এলাহি ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত টানা দুই দশক সময়ের মাঝে পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। করাচি সেন্ট্রাল জেলে মেয়াদ খাটাকালে তিনি জারদারিসহ পাকিস্তান পিপল্স পার্টির (পিপিপি) আরও অনেক নেতাকে সঙ্গী হিসেবে পান।
সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এলাহি বলেন, ‘জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক শাসনামলে জারদারি ও (তার নিহত স্ত্রী পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) বেনজীর ভুট্টোর সঙ্গে আমি একই জেলে ছিলাম। প্রতি রোববার জেলখানার আঙিনায় জারদারির সঙ্গে মোলাকাত হতো আমার।
বিগত ৬০ ও ৭০ দশকে দায়িত্ব পালনকারী মাতৃভূমির প্রতি নিবেদিত ভারতীয় গুপ্তচরদের অন্যতম মেহবুব এলাহি তার চাকরি জীবনে গুপ্তচরবৃত্তির প্রয়োজনে দু’বার পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেন। একবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) হয়ে এবং দ্বিতীয়বার ভারতের পশ্চিম সীমানা দিয়ে।
সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানি জেলে জারদারির সঙ্গে এলাহি কিভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন তার বয়ান দেন। ‘তিনি পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জিয়াউল হকের অপশাসন ও দলন-পীড়ন সম্পর্কে কথা বলতেন। জেলে তার বিশাল সমর্থন ছিল। ’
এলাহি বলেন, ‘জেলে জারদারির খুব প্রভাব ছিল এবং তিনি ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। জেলে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিরা পাকিস্তানি বন্দিদের চাকর হিসেবে কাজ করতো, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ধুয়ে দিত। সে সূত্রে জারদারির জন্যও ভারতীয় বন্দিরা একই কাজ করতো। তবে এক্ষেত্রে জারদারি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি ভারতীয় বন্দিদের সঙ্গে কথা বলতেন, প্রায়ই তাদেরকে সাবান ও মিষ্টি কিনে দিতেন। ’
প্রথম পর্যায়ে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্য্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ দেশটির অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পরিচয়ে গুপ্তচরগিরি করেন এলাহি।
গ্রেফতার হওয়ার পর পাকিস্তানিদের করা নির্যাতনের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন এখনও বিদ্যমান ৫২ বছর বয়সী এই আলোচিত গুপ্তচরের সারা শরীরজুড়ে। পাকিস্তানি জেলে মেয়াদ খাটাকালে তিনি শত শত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি ও জেলের সাক্ষাৎ পান। তারা বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি জেলগুলোতে সাজা ভোগ করছে।
‘আমি সেখানে শত শত ভারতীয় বন্দির দেখা পেয়েছি যাদের অধিকাংশ যুদ্ধবন্দি। পাকিস্তানিদের মানবিক নির্যাতনে তাদের অনেকেই উন্মাদ হয়ে গেছে অথবা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের নম পর্যন্ত মনে করতে পারে না। ’ বলেন এলাহি।
আক্ষেপ প্রকাশ করে এলাহি আরো বলেন, “ভারত সরকার বা সেনাবাহিনী- কেউ’ই দেশের সেইসব ‘সত্যিকারের নায়ক’দের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়নি। ”
জারদারির ৬ ঘণ্টার ভারত সফরের সময়ে তার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় জানিয়ে এলাহি ভারতে অবস্থিত পাকিস্তানি হাই কমিশনে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু এতে কোনও সাড়া পাননি তিনি।
‘আমি পাকিস্তানি হাই কমিশন থেকে কোনও জবাব পাইনি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- ভারতের রাষ্ট্রপতি (প্রতিভা) পাতিলকেও আমি লিখেছিলাম। কিন্তু তিনিও জবাব দেননি। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি দুটি দেশের অভিন্ন আচরণে আমি হতাশ!’
১৯৯৬ সালে পাকিস্তানিদের খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে মেহবুব এলাহি সেদেশের জেলে থাকা ভারতীয় সাধারণ নাগরিক ও যুদ্ধবন্দিদের মুক্ত করার দাবিতে ব্যাপক সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি কারাগার থেকে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের মুক্ত করার দাবিতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের শাসনামলে তিনি নয়াদিল্লিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এমনকি এজন্য পার্লামেন্টের সামনে গিয়ে আত্মাহুতির হুমকিও দেন। একপর্যায়ে তৎকালীন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জশবন্ত সিং তাকে আশ্বস্ত করেন যে ভারত সরকার বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাক্ষা করে চলেছে।
এলাহি বলেন, ‘ভারতীয় বন্দিদের সেখানে প্রতিদিন নির্যাতন করা হয়। আমিও নির্যাতিত হয়েছি। ১৯৯৬ সালে সেখানে ১৩৩৫ জনের মত ভারতীয় বন্দি ছিল। এখন এই সংখ্যা হয়তো বেড়েছে বা কমেছে- কিন্তু আসল কথা হলো পাকিস্তানে এখনও অনেক ভারতীয় যুদ্ধবন্দি আছে। ’
এলাহি পাকিস্তানের জেলজীবনের স্মৃতিচারণে আরও জানান, ওই সময়ে কারাবন্দি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে হত্যা করতে তাকে কিভাবে প্রলুব্ধ করেছেন জেনারেল জিয়াউল হকের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা। এর বিনিময়ে তারা তাকে প্রচুর অর্থ ও মুক্তি দেওয়ার লোভ দেখিয়েছিল। জিয়াইল হকের নেতৃত্বে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী ওই সময়টায় ভগ্ন মনোরথ ও জীবন সংশয়ে থাকা একদার প্রচণ্ড দাপুটে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোর জেলে বন্দি ছিলেন।
‘আমাকে একটি ব্ল্যাঙ্ক চেক অফার করা হয় এবং মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়- বিনিময়ে হত্যা করতে বলা হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। কিন্তু আমি এতে অস্বীকৃতি জানাই। ’ বলেন এলাহি।
এদিকে, ‘ভারতে অধিকাংশ মুসলমানকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়’ উল্লেখ করে মেহবুব এলাহি হতাশা প্রকাশ করেন।
‘মুসলমানরা দেশপ্রেমিক। তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিৎ নয়। মুসলমানরা তাদের মাতৃভূমির জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত,’ আবেগভরা কণ্ঠে বলেন এলাহি।
পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি জারদারি তার সংক্ষিপ্ত সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের পর মুখোমুখি বৈঠকে বসবেন। এরপর আজমীরে সুফী সাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তির মাজার জিয়ারত শেষে দেশের পথে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে তার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ০৮ এপ্রিল, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিট