ঢাকা : বসুন্ধরার প্রধান সড়ক ধরে অফিসে যাওয়ার পথে হঠাৎ চোখ গেল ‘চার ফুলপরী’র দিকে। না ভুল বললাম, ফুলপরী ৪জন নয়, ৩জন।
মাথায়, হাতে, কোমরে ও গলায় হলুদ গাঁদা ফুলের মালায় জড়িয়ে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ওরা, তাতে কেবল আমি নই- পথচারী সবারই চোখ আটকে যাচ্ছিল ‘ফুলপরিহিত’ ছিন্নমূল শিশুগুলোর দিকে।
কথা বলে জানা গেল, অবিজাত বসুন্ধরা আবসিক এলাকার দক্ষিণে সোলমাইদ বস্তিতে ওদের বাস। দরিদ্র বাবা-মার আয়-রোজগারে ঠিক মত চলছে না সংসার। তাই শহরের আলিশান দালান-কোঠার আনাচে-কানাচে কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিকের টুকরা, ফেলে দেয়া বাতিল সামগ্রী, কাঠের টুকরা ইত্যাদি কুড়িয়ে তা বেঁচে সামান্য আয় করে সংসারে সহায়তা করে তারা।
প্রতিদিন এসব সংগ্রহে বের হয় তারা। তবে ওইদিন নিত্যদিনের কুড়ানো সামগ্রী ছাড়াও জুটে আরো কিছু। ধণবান কোনো পরিবারের বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে ব্যবহারের পর ফেলে যাওয়া ফুল কুড়িয়ে পায় তারা।
বিনা পয়সায় এই আক্রার বাজারে রাজধানী ঢাকা শহরে এত ফুল, তাও আবার প্রায় তরতাজা!
বিয়েবাড়ির বা বরের গাড়ির ফুলের সাজ বা বিভিন্ন উৎসবের দিনে সুবর্ন কঙ্কণ পরা পুষ্পসজ্জিত অভিজাত নারীদের চলার পথে অনেকবার দেখেছে তারা। তবে ফুলেল গহনায় আচ্ছাদিত মোহনীয় রূপে কখনো নিজেকে বর্ণিল করে তোলার সুযোগ হয়নি করওই। তাই সুযোগ যেহেতু মিললই, তখন তার সদ্ব্যবহার করা চাই!
ফুল পাওয়ার আনন্দে সেদিন পরিত্যক্ত সামগ্রী কুড়ানোর কথাও একরকম ভুলেই যায় তারা। কুড়িয়ে পাওয়া গাঁদাফুলের মালায় ভাল করে নিজেদের জড়িয়ে নিজেরাই একে অন্যের দিকে দেখছিল- কার চেয়ে কাকে বেশি ভাল লাগছে!
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে দারিদ্রই যাদের নিত্যসহচর, সেসব শিশুদের কাছে কুড়িয়ে পাওয়া ফুলের আনন্দ যেন প্রকাশের নয়।
প্রায় ঘণ্টাকাল তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আরও জানা যায়, এত কষ্টের মাঝেও আনন্দ আছে তাদের মনে। দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা ওরা চারজন হচ্ছে- কামরুল ইসলাম(১১), খাদিজা(১১), চম্পা(১০) ও রোকসানা(৮)।
কামরুল জানায়, তার বাবা কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের বাইলারা গ্রামের বাসিন্দা রিক্সাচালক আলাউদ্দিন। বাবার একার রোজগারে সংসার চলে না, তাই কিছু টাকা কামাই করতেই তাকে বেছে নিতে হয়েছে ‘টোকাই’ জীবন।
ফুটফুটে মেয়ে খাদিজা। বাবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের শারীরিক প্রতিবন্ধী সেতুল মিয়া, মা সুফিয়া নির্মাণ শ্রমিক। বাবা কিছুই করতে পারে না। মায়ের রোজগারে চলা সংসারে অভাব সবসময় লেগেই থাকে।
চম্পার বাবা মোসেন মিয়া ভ্যান চালক। বাড়ি কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের নুফুদি গ্রামে।
ছোট্ট মেয়ে রোকসানা। তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ। বাড়ি নেত্রোকোনা জেলায়।
এসব শিশুদের সবাই সোলমাইদের ফরাজীতলা বস্তিতে থাকে। তারা জানায়, টোকাইগিরি করেও তারা ওই এলাকার বাটারাপট্টির ‘গরীবের বন্ধু’ নামে এনজিও পরিচালিত একটি স্কুলে পড়ে।
স্কুলটি বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ ছাড়াও কাপড়, বই-খাতাসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ দেয় বলে তারা জানায়।
তারা আরো জানায়, প্রতিদিন এটা-সেটা কুড়িয়ে প্রত্যেকে ২৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা পযন্ত রোজগার করতে পারে।
বড় হয়ে কি হওয়ার স্বপ্ন দেখ- জিজ্ঞেস করলে বঞ্চনার শিকার এই শিশুরা সমস্বরে বলে ওঠে ‘বড় অফিসার অমু, দামি গাড়ি ত চড়মু (রাস্তায় চলমান প্রাইভেটকার দেখিয়ে)। ’
কথা শেষ করে চলে আসার আগ মুহূর্তে যখন ছিন্নমূল এই চার শিশুর ছবি তোলা হচ্ছিল, তখন কৌতূহলী হয়ে ওরা জানতে চাইলো, ‘স্যার আমাগো ছবি দিয়া কী করবেন?’ পত্রিকায় ছাপা হবে জানতে পেরে ওদের আনন্দে যেন আর ধরে না!
মনের আনন্দে উল্লাস করতে করতে যখন ফিরে যাচ্ছিল ফুলেল সাজে সজ্জিত শিশুদের দলটি বিষ্মিয়াভিভূত চোখে স্থানুর মত তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ, শুধু আমি না, রাস্তার অন্যান্য পথচারী, আর পাশের রাজকীয় ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকাদের কেউ কেউ। মনে হলো কুড়িয়ে পাওয়া কিছু ফুল তাদের যে আনন্দ দিয়েছে তা অনেক অবস্থাপন্ন অবিভাবক তাদের আদরের সন্তানদের হালের আইফোন-আইপ্যাড কিনে দিয়েও দেখতে পান কি না সন্দেহ!
এ আনন্দ অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। এর অবস্থান হচ্ছে সন্তুষ্টচিত্ত অর্থাৎ অল্প পেয়ে তুষ্ট মানুষদের মনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘন্টা, এপ্রিল গ৯, ২০১২
এআই
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর