এসো হে বৈশাখ, এসো এসো... এমনই গান গেয়ে শুরু হবে বাংলা ১৪১৯ বঙ্গাব্দ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি রঙের খেলায় মেতে ওঠবে বাংলাদেশ।
বাঙালিয়ানার সঙ্গে মাতবে নতুন প্রজন্ম। নতুনদের কণ্ঠে বাজবে বৈশাখের সুর। তাদের কাছেই স্বপ্নযাত্রার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে। এনিয়েই স্বপ্নযাত্রার বিশেষ আয়োজন।
ফাহমিদা ওয়াদুদ চৈতি, প্রকৌশলী, চ্যানেল নাইন
আমার ছোটবেলা শিশু একাডেমী, ছায়ানট, আর বিভিন্ন শিশু-সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় কেটেছে। তাই পহেলা বৈশাখ মানে এর আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে টানা অনুশীলনে কাটাতে হয়েছে। বছরের প্রথম ভোরে আব্বু-আম্মুর সঙ্গে বের হওয়া। আমার ঘুম-ঘুম চোখ। মা আমার কস্টিউম, স্ক্রিপ্ট গুছিয়ে নিচ্ছে। এভাবেই গেছে।
সারাদিন গান গেয়ে, গান শুনে, আবৃত্তি কিংবা উপস্থাপনা করে, রমনায় নাগরদোলায় চড়ে, চারুকলায় ঘোড়া-পাখি-মুখোশের সঙ্গে ছবি তুলে, দুপুরে বাইরে খেয়ে কেটে যেত আমাদের সারাদিন। আমরা যখন বাড়ি ফিরতাম, তখন আমি মহা আনন্দে থাকতাম। অনেক ক্লান্ত লাগতো। ভাবলে অবাক হই, এখনকার প্রতিটি পহেলা বৈশাখেও সারাদিন বাইরে থেকে ঘরে ফিরে দেখি- আম্মুর বৈশাখী খাবার টেবিলেই সাজানো আছে।
টেলিভিশনের চাকরি বলে এখন কাজের কারণেই ব্যস্ত থাকতে হয় পহেলা বৈশাখে। তারপরও নতুন বছর, নতুন পোশাক, উপহার আর আনন্দে সময় কেটে যায়। আমার সেই ভয়ঙ্কর এনার্জেটিক মা এখন ৫৬, প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। তারপরও, এবারও আমাকে নতুন বছর উপলক্ষে একটি শাড়ি কিনে দিয়েছেন। বুধবার পাশের বাসার পিচ্চিটা বলল, ‘আমি পহেলা বৈশাখের গান জানি- শুনবা?’ বলেই শুরু করল- ‘এসো হে বৈশাখ… ’ ওদের স্কুলে শিখিয়েছে।
মিডিয়া, কাপড়ের দোকান, পার্লারের কল্যাণে ইদানিং পহেলা বৈশাখ অবশ্য অনেক বেশি ব্যাপকতা পেয়েছে। তবে আমি পান্তা-ভাত আর ইলিশ মাছ খাওয়ার বিষয়টা আজও বুঝে ওঠতে পারিনি। বছরের শুরুর দিনে কি কেউ বাসি ভাত খায়? আর বৈশাখের আগেই যদি নদী সেচে ইলিশ-জাটকা সব ধরে ফেলা হয়, তাহলে বর্ষায় নদীতে আর কি থাকবে?
নাভীলা রহমান নদী, শিক্ষক, অতীশ দিপংকর ইউনিভার্সিটি
‘পহেলা বৈশাখ’ শব্দ দুটি শুনলেই ইচ্ছে করে নিজেকে শত রঙে সাজাতে। আমার কাছে পহেলা বৈশাখ মানেই হলো চারিপাশে রঙের খেলা। ইচ্ছে মত নানান রঙে সাজা।
মাঝে মাঝে নিজেই ভাবি ছোটবেলার বৈশাখ কেমন ছিল। তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আম্মুর পেছন পেছন রমনা ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরছি। শাড়ি পরে কড়া রোদে ঘুরে যে আনন্দ তা আজও ভুলতে পারি না।
এমন দিনে শাড়ি না পরলে হয়? শাড়ি পরতে পারবো। আয়োজন করে শাড়ি পরতে পারার মধ্যেও যে আনন্দ তা বলে বোঝাতে পারবো না।
আগে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই আম্মু ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাইয়ে দিত। তখন মনে হতো, যাহ্! তাহলে এবারের বৈশাখটা স্বার্থক হলো। কিন্তু এখন হয়ে গেছে উল্টো। এখন ইলিশ খাওয়ার আগে দামের কথা ভাবতে হয়।
জীবনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবনা বদলায়। রূপ বদলায়। আমরাও তো বদলাই। আগে যেখানে শাড়ি পরার মধ্যেই আনন্দ ছিল। এখন তো শাড়ি কেনার আগে ভাবতে হয় দামের কথা। সঙ্গে বর্তমানে কোন শাড়িটি চলছে। ভিন্ন স্টাইলে কীভাবে সাজা যাবে; এসব নিয়েই ভাবতে হয়। কড়া রোদে অসুস্থ হয়ে পড়বো নাতো!
কত কী ভাবনায় আচ্ছন্ন হতে হয়। তাও রঙের মেলায় থাকতে ভালো লাগে। বছরে অন্তত একটি দিন বাঙালির সাজে নিজেকে দেখতে ভালো লাগে। এদেশের মানুষগুলোর রঙের মাঝে হারিয়ে যাওয়া দেখতেও ভালো লাগে। একটি দিন কোলাহলই ভালো লাগে। এবারো যাবো কোলাহলের মাঝেই। যেখানে রঙ থাকবে। গান থাকবে। নিজস্বতা থাকবে।
হাসিবুল হক, আর্কিটেক্ট, মডিউলার ডিজাইন স্টুডিও
আমরা যারা ঢাকায় থাকি, তাদের জন্য উৎসবের জন্য উপলক্ষ্য দরকার। একটা কিছু পেলেই হলো। আমরা সবাই নেমে পড়ি আনন্দের ঢেউয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার বৈশাখ উদযাপন মূলত বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের আয়োজনকে ঘিরেই চলে। বৈশাখ আসার আগেরদিন পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিতে থাকে, সব ভবনগুলোকে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। সকালবেলার র্যালি উপলক্ষে বানানো হয় অনেক মুখোশ।
বৈশাখের আগের রাতে সবাই মিলে আলপনা করি। সেখানে প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ বর্তমান শিক্ষার্থীরা সবাই জমায়েত হয় এবং সারারাত গান বাজনা করে। এবারও আমি থাকবো সেখানে। ভোরবেলায় বাসায় এসে ফ্রেশ একটা ঘুম দিয়ে ওঠে এরপর হয়তো বের হব রঙ্গিন ক্যাম্পাসের বৈশাখ আয়োজন দেখতে।
সকাল থেকে যেহেতু সেখানে অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং রাতে কনসার্টের মধ্য দিয়ে শেষ হয়, তো দিনের বড় একটা অংশ সেখানেই কাটানো হবে। বন্ধুদের সাথে এবং বড় ভাইদের সঙ্গে মিলন মেলায় পরিণত হয় বৈশাখের অনুষ্ঠান। তাই দিনটির জন্যে অপেক্ষায় আছি।
ফারজানা জামান রূম্পা, লেখক ও বিজ্ঞাপনকর্মী
জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যদি একটি উৎসবের নাম বলতে বলা হয়, নিঃসন্দেহে নামটি হবে ‘পহেলা বৈশাখ’। বৈশাখের প্রথম এই দিনটি বাংলাদেশিদের জন্য, বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য অসম্ভব আনন্দের একটি দিন।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাঙালির আনন্দে মেতে উঠার মতো এমন উপলক্ষ্য বছরে একবার আসে বলেই আনন্দের মাত্রাটা অনেক বেশি। প্রতিবছর বৈশাখের সকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের গান শুনতে যেতেই হবে। সেই কিশোরবেলা থেকে আজকের বড়বেলা পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম হয়নি।
এরপর চারুকলার রঙিন র্যালি উপভোগ করা। এখানে সেখানে গান-বাজনা শোনা, ভর্তা-ভাজি দিয়ে ভুড়ি ভোজ, বন্ধু, পরিবারের সঙ্গে আড্ডাবাজি। এই হলো আমার পহেলা বৈশাখের রুটিন। আজকাল সবাই নতুন জামা পরে, আমরা বন্ধুরা অনেক আগে থেকেই নতুন জামার ব্যবস্থা করতাম। পারলে একই রকম বানাতাম। এবারো ইচ্ছা আছে সেভাবেই পালন করার।
আগে হাল খাতার প্রচলনটা শহরেও ব্যাপক আকারে ছিল। যেটা এখন দেখা যায় না। ‘বনি করা’র বিষয়টা ছিল। দিন গড়ানোর সাথে সাথে দিন সত্যি বদলায়। প্রতিবছর একটু একটু করে আগের ঐতিহ্য রূপ বদলে যাচ্ছে, আসছে নতুন ট্রেন্ড।
যেহেতু এখন ফেসবুকের যুগ, ছবি তোলা, ফেসবুকে নানা ইভেন্ট আয়োজন করা চলবেই। কিন্তু তা যেন হয় জেনে শুনে। আমরা অনেকেই জানিনা যে, বাংলাদেশেই পহেলা বৈশাখ নিয়ে উৎসব শুরু হয়েছিল। আমরা জানি না, বটমূল কিভাবে এই উৎসবের সাথে মিশে গেছে। আমাদের প্রজন্মের দায়িত্ব এই সব বিষয় আমাদেরকেই জানতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে পরের প্রজন্মের মাঝে।
আমরা নিজেরাই যদি পরবর্তী প্রজন্মকে ‘বাংলা মাস’ না শেখাই তাহলে এই দিনটি হবে অর্থহীন। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, মানুষ কেন তার শিঁকড় ভুলে যাবে?
মারুফ উল হক, সদস্য, নির্ঝর
সবাই ইংরেজি নববর্ষে যেভাবে আনন্দ করে আমার তেমন করা হয় না। কিন্তু বাংলা নববর্ষকে আপন মনে হয়। মনে হয়, এটাই তো আমার আপন। আমার নিজস্বতা। যেহেতু নিজেদের একটি ব্যান্ডদল আছে; তাই প্রতিবছর নববর্ষে বিভিন্ন কনসার্টগুলোতে যেতে হয়। প্রতিবছরই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ঘুরতে পারি না। এবার আশা করছি বন্ধুদের সময় দিতে পারবো।
পহেলা বৈশাখের কেন্দ্রবিন্দু থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এবার সেখানেই সময় কাটাবো। হাসি গানে আড্ডায় বাঙালির রঙের মেলায় মেতে ওঠবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১২
সম্পাদনায়: আরিফুল ইসলাম আরমান, নিউজরুম এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর