ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বাঁশরিয়া বাজাও বাঁশি...

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:০৬, এপ্রিল ১৩, ২০১২
বাঁশরিয়া বাজাও বাঁশি...

ঢাকা: ‘কার বাঁশরি বাজে/মুলতান সুরে/নদী কিনারে, কে জানে’- বাংলা সংগীত কিংবা সাহিত্যে বাঁশির এমন সরব উপস্থিতি শিল্পরসিক যে কারোরই হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয়, কথা কয়ে ওঠে।

যান্ত্রিক যুগে নগরে কি গ্রামে, কোথাও বাঁশির সেই আবেগী সুর আগের মতো আর শুনতে পাওয়া যায় না।

তারপরও যখন কানে ভেসে আসে চিরচেনা সেই সুর, তখন উদাসী মন হঠাৎই থমকে দাঁড়ায়। ক’দিন আগে চলার পথে ভরদুপুরে এক বাঁশির সুর, ঠিক তেমনি থমকে দিয়েছিল চলার গতি।

ময়মনসিংহ ও গাজীপুর জেলাকে বিভক্ত করেছে সুতিয়া নদী। নদীর দক্ষিণে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ আর উত্তরে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়ন।  

নদীর দক্ষিণ পাড়েই প্রকাণ্ড এক কড়ই গাছ। গাছটির গোড়া থেকে মাটি সরে প্রসারিত হয়ে আছে বড় শেকড়গুলো, নদীর কিনার দিয়ে যাতায়ত করা ক্লান্ত পথিকের একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্যই যেন বৃক্ষের এ উদারতা!

পছন্দের মানুষকে মন খুলে প্রাণের সত্যি কথাটি বলতে না পেরে শিল্পীমনের কেউ কেউ বাঁশিতে সে কথা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। কেউবা ব্যর্থ প্রেমের অভিব্যক্তিকেই জানান দেন বাঁশির সুরে। তবে ওইদিন কাওরাইদে যে বাঁশির সুর শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটি এসব কারণে নয়- তা জানা গেল সেই বংশীবাদকের সঙ্গেই কথা বলে।

বিনোদনের সুবিধাবঞ্চিত অজপাড়াগাঁয়ের যুবক শাহ আলম (১৯) নিজের মনের একান্ত কিছু দুঃখকে জয় করতেই সুতিয়া নদীর তীরে কড়ইতলায় বসে বাঁশি বাজান। গ্রামাঞ্চলে বাউন্ডেলেদের মধ্যে অলস দুপুরে বাঁশি বাজানোর চিরাচরিত প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও শাহ আলম স্থানীয় কাওরাইদ বাজারে ফার্ণিচারের দোকানে কাজ করেন।  

সৌভাগ্যবশতঃ ছোট বড় তিন সমঝদার শ্রোতাও জোটে তার ভাগ্যে। পরম আনুগত্য ও নীরবতা পালন করে বাঁশি শুনছিল-ইব্রাহীম (১৮), ফাহাদ হোসেন (৯) ও রাফি (৮)। শুধু ওই দিনই নয়, প্রতিদিন এরকম শ্রোতার অভাব হয় না শাহ্ আলমের।  

তিন বাঁশিভক্তের মধ্যে, ফাহাদ দ্বিতীয় ও রাফি প্রথম শ্রেণীতে পড়ে আর ইব্রাহীম কাজ করে শাহ আলমের সহকারী হিসেবে। ছোট্ট রাফি ক্ষুদ্রাকৃতির একটি বাঁকানো দা’ হাতে ঝড়ে কুড়ানো আমের খোসা ছাড়াচ্ছে। বাঁশি শুনতে শুনতে নিঃশব্দেই সে কাটা আমের কুচি তুলে দিচ্ছে অন্যদের হাতে।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, কাওরাইদে প্রায় শতবর্ষ আগের স্যার কেজি গুপ্তের কাচারি বাড়ির সুতিয়া নদীর তীর ঘেঁষে লিচু বাগানে বসেই ‘মোদের গরব/ মোদের আশা/ আমরি বাংলা ভাষা’ গানের রচয়িতা অতুল প্রসাদ সেন বিখ্যাত অনেক গান রচনা ও সুর করেছিলেন। ঐতিহাসিক কিন্তু বিস্মৃত সেই অঙ্গনে এমন বাঁশির সুর যেন নতুন আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে।  

অনেকটা অনধিকারচর্চার মতোই ‘অন্যজগতে’ হারিয়ে যাওয়া এই বাঁশি প্রেমিকদের কাছে গিয়ে বসতেই হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে যায় ওরা। কিছু সময় তাদের নানা গল্প শোনার পর পছন্দের অনেক গানের সুর বাঁশিতে তুলে শোনায় শাহ আলম। শোনায় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি। ’

শাহ আলম জানালেন ‘সংসারে অভাবের কারণে কোনো রহম ফাইভ পাস কইরাই পড়া ছাইড়া দিছি। এ্যাহন কাম করি ফার্নিচারের দোহানে। লগের বন্ধুরা কলেজে যায়। দেইখ্যা মন খুব খারাপ অয়ইয়া যায়। তাই কামের ফাঁকে মনের দুঃখ দূর করবার লাইগ্যা বাঁশি বাজাই। ’

গ্রামীণ এই বংশীবাদকের সঙ্গে গল্প শেষ করে যখন নির্দিষ্ট গন্তব্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছি, আধ মাইল দূরে তখনও ভেসে আসছিল শাহ্ আলমের বাঁশির সুর।

বাঁশি বিষয়ক কিছু তথ্য:
ফুৎকার (ফুঁ) দিয়ে বাজানো যায় এমন এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাঁশি। বাঁশ দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে এর নাম বাঁশি। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বাঁশির পাশ্চাত্য সংস্করণের নাম ফ্লুট (flute)।  

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বা চিকন বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ সখের বশে স্টিলের, তামার, পিতলের, রূপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরি করিয়ে থাকেন।

প্রাচীন এই বাদ্যযন্ত্রের গায়ে সাতটি কখনো আটটিও ছিদ্র থাকে। যে নল বা পাইপটি দিয়ে বাঁশি তৈরি করা হয়, তার একপাশ সম্পূর্ণ আটকে বায়ুরোধী করে দেওয়া হয়। বাঁশের তৈরি বাঁশিতে গিট বা গেরো একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজ করে।  

বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে নিয়মানুযায়ি ফুঁ দিতে হয় এবং বাকি ছ`টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়। বাঁশি বাজানো একটি গুরুমুখি বিদ্যা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১২

এআই/সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।