ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

চড়কপূজায় একবেলা

আশরাফুল ইসলাম ও এ কে এম রিপন আনসারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:২৯, এপ্রিল ১৪, ২০১২
চড়কপূজায় একবেলা

গাজীপুর থেকে : গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান থেকে একেঁবেঁকে পশ্চিমদিকে চলে গেছে একটি রাস্তা। গ্রামের এ মেঠোপথ ধরে ১ কিলোমিটার যেতেই গজারিয়াপাড়া গ্রাম।

এক সময় ঘনগভীর গজারীবন বেষ্টিত এ গ্রামের এখন আর আগের সেই শোভা নেই। সেই বনের অস্তিত্ব নেই।

তারপরও, স্থানীয়দের জীবনাচারের উদ্যম আর উৎসবমুখরতা পুরোটা ম্লান হতে দেয়নি গ্রামের একসময়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যভরা আবেদনকে।  

গ্রামের সিংহভাগ মানুষই কোচ আদিবাসী সম্প্রদায়ের। কেবল এ গ্রামেই নয়, এর আশপাশের নান্দুয়াইন, বাওপাড়া, পলাশতলী, সিতপাড়া, কুমারপাড়া, হাতিয়াব, মণিপুর গ্রামেও কোচ জনগোষ্ঠীর বসবাস। এ অঞ্চলে বিগত কয়েক দশকে ব্যাপক শিল্পায়নের প্রভাবে নৃ-তাত্ত্বিক আদিবাসী জনগোষ্ঠির জীবন-যাত্রায় আমূল পরিবর্তন আসলেও বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত অনেক ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সযত্নেই লালন করে চলছেন তারা।

একসময় শুধু নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়েই গজারিয়াপাড়ার আদিবাসীরা তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান উদযাপন করে আসলেও সময়ের পরিবর্তনের  সঙ্গে সঙ্গে এলাকার বাসিন্দা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও এতে একাত্ম হয়ে গেছে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে এখানকার কোচ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে চৈত্র সংক্রান্তিতে আয়োজন করে আসছে চড়কপূজা ও বৈশাখী মেলা।

অন্য বছরের মত এবারও পহেলা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তিতে এই আনন্দযজ্ঞে মিলিত হয়েছিল সব সম্প্রদায়ের মানুষ। বিশেষ করে শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত এলাকার হাজার হাজার শ্রমিক এতে যোগ দেয়ায় ভিন্ন আবহ সৃষ্টি হয় এ মেলায়।  

আদিবাসী সম্প্রদায়ের চড়কপূজার প্রধান আনুষ্ঠানিকতা বড়শিবিদ্ধ মানুষকে চড়কে ঘুরানো এই উৎসবের মূল আকর্ষণ হলেও অনুষ্ঠানস্থলের পাশেই উন্মুক্ত বাইদে (পতিত ধানের ক্ষেতে) নানা মুখরোচক দেশিয় খাবার ও আকর্ষণীয় খেলনা সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসা দোকানগুলো আগত বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর আনন্দকে আরো উপভোগ্য করে তোলে।

মুশকিল আসানের আশায় চড়কপূজায়
‘বিয়ের পর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর, কোনো সন্তান হচ্ছে না, পরিবারে অসুথ-বিসুখ লেগেই আছে- অনেক চিকিৎসা করানোর পরও আরোগ্য লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। ’ কোচ আদিবাসী সম্প্রদায় দৈনন্দিন নানান সমস্যার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে সমাধান খোঁজেন চৈত্রসংক্রান্তির চড়কপূজায়। তারা বিশ্বাস করেন, এখানে মানত করলেই ‘মুসকিল আসান’ হবে-সমাধান মিলবে এসব সমস্যার। শুক্রবার গাজীপুর জেলার বনঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম গজারিয়াপাড়ার চড়কপূজা ঘুরে জানা যায় এসব তথ্য।

মূল আকর্ষণ
জলজ্যান্ত মানুষকে পিঠে বড়শি বিঁধিয়ে চড়ক গাছে ঘুরানো। দুঃস্বাহসিক ও লোমহর্ষক এ খেলা দেখতে প্রতি বছর গজারিয়ায় দূর-দূরান্ত থেকেও ভিড় জমান হাজারো মানুষ। চড়কপূজার প্রধান পুরোহিত (মাত্যমা) নিখিল সন্যাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল চড়কপূজার অনেক কিছুই।

তার মতে- চড়কে বড়শিবিদ্ধ মানুষকে ঘুরানোর বিষয়টি পুরোটাই ‍তান্ত্রিক সাধনার বিষয়। যে ব্যক্তিকে বড়শিবিদ্ধ করে ঘুরানো হয় চড়ক গাছে, তাকে এক সপ্তাহ পূর্বে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। পিঠের যে অংশে ঢুকানো হয় বড়শি, সেস্থানে খাঁটি ঘি মাখতে হয় এক সপ্তাহ ধরেই। এতে ওই স্থানের চামড়া অনেকটা নরম হয়ে আসে। তান্ত্রিক নিয়মে আবদ্ধ ওই ব্যক্তির পক্ষে এসময়টায় দুধ-কলা ছাড়া অন্য কোনো খাবার গ্রহণ নিষিদ্ধ থকে, এমনকি পানিও না। বড়শিবিদ্ধ করে চড়কে ঝুলিয়ে দেয়ার পর ওই অবস্থায় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ঝুলতে থাকেন ওই ব্যক্তি।

গজারিয়াপাড়ার চড়কপূজায় শিব-কালীর বেশে রামদা-ত্রিশূল হাতে বড়শিতে ঝুলন্ত অবস্থায়ই উদ্দাম নেচে চলে ওই যুবক। ঝুলন্ত অবস্থায় নিচের হাজারো দর্শণার্থীদের ছিটিয়ে দেয় খেলনা-বাতাসা-পানি, মুণ্ডুহীন কবুতরের বাচ্চা, আমেরকুড়ি ইত্যাদি। এসময় হাজার হাজার পুণ্যার্থীর মুহূর্মুহু উলুধ্বনি আর ঢাক-কাঁসি-শাঁখ-শিঙ্গার শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।

প্রথম প্রথম অবিশ্বাস্য মনে হলেও দেখা গেল- চড়ক গাছ থেকে নেমে বড়শি খোলার পর অন্যদের মতই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছেন ২০ বছর বয়সি কৃষ্ণ। কোনো রক্তও ঝরতে দেখা যায়নি তার পিঠ থেকে। তবে আরও এক কিশোরকে চড়কে তোলার জন্য প্রস্তুত করা হয়। বড়শিও গাঁথা হয়। কিন্তু শেষ পর্যায়ে ছেলেটি ভীত হয়ে পড়ায় তাকে আর চড়কে তোলা হয়নি। জানা গেল, এক বা একাধিক ব্যক্তিকে চড়কে তোলা হয়ে থাকে।
 
দীর্ঘকাল থেকেই গাজীপুরের এই অঞ্চলে চড়কপূজা ও বড়শি বিধানো মানুষের খেলার প্রচলন থাকলেও গত ২১ বছর ধরে রীতিমত জাকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করা হচ্ছে এ উৎসব। এ বছর ২২ তম বছরে পদার্পণ করে উৎসব। ৪২ বছর বয়সী পুরোহিত নিখিল সন্যাসী গত ১৮ বছর ধরে চড়কপূজায় প্রধান তান্ত্রিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি জানান, যে কেউ এ খেলা দেখতে পারেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে অপবিত্র শরীরে যদি কেউ এ পূজা বা খেলা দেখতে আসেন, সেক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।

তিনি আরো জানান, মন্ত্র দ্বারা এ কাজ করতে হয়। তাই যারা এটা করবেন তাদের মিথ্যা বলা পরিহার করতে হয়। সৎ চরিত্রবান হতে হবে এবং অন্যের দুর্ণাম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তার ভাষায় ‘নিয়মনিষ্ঠায় করলে বংশবৃদ্ধি হয়/ অনিয়মে করলে বংশ বিনাশ হয়। ’

স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের কেউ তার সন্তানকে বড়শিবিদ্ধ করে চড়কে ঘুরাতে পারলে সৌভাগ্যবান মনে করেন। তারা একে দেখেন সাহসিকতা ও পবিত্রকর্ম হিসেবে। বিশেষ করে মহাদেব শিবঠাকুরকে সন্তুষ্ট করতে এবং নিজেদের মনোবাসনা পূরণের জন্য এই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বাংলা বছরের বিদায়ের দিনের এই মুহূর্তটি খুবই আকাঙ্খিত।    

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ বছরের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্য পূজা-পার্বণের চেয়ে অনেকটা ব্যতিক্রম চড়ক  পূজার আনুষ্ঠানিকতার ধরন। আদিম লোকাচারের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এর আনুষ্ঠানিকতা। বিভিন্ন দৈহিক যন্ত্রণা এ পুজোর অন্যতম অঙ্গ বলে বিবেচনা করা হয়।

পুরোহিত ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, চড়ক পূজা মূলতঃ গ্রামীণ কৃষি দেবতা শিবের আবাহন। দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি, নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভ, মনের বাসনা পূরণসহ মহাদেবতা শিবের সন্তুষ্টি লাভই এ পূজার উদ্দেশ্য।

শিবের গাজন, গম্ভীরা পূজা, নীল পূজা বা হাজরা পূজাও চড়ক পূজার নামান্তর। সাধারণত তথাকথিত ‘নীচু বর্ণের’ হিন্দুরা চড়ক পূজার আয়োজন করেন।

উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণরা কখনো এ পূজায় অংশ নেন না। তবে আধুনিককালে কিছু এলাকায় কথিত ‘উচ্চ বর্ণের’ হিন্দুদেরও চড়ক পূজার আয়োজনে শামিল হতে দেখা যায়।

কবে থেকে চড়ক পূজার প্রচলন হয়- এর সঠিক ইতিহাস এখানো অজানা। ‘লিঙ্গপুরাণ’, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ এবং

‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এর মতো আদি ধর্মগ্রন্থগুলোতে শিবারাধনার উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই।

গোবিন্দনন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ এবং রঘুনন্দের ‘তিথিতত্ত্ব’-তেও বলা হয়নি চড়ক পূজার কথা । অনেকের মতে, এটি বৌদ্ধ ধর্মীয় ঠাকুরের পূজার বিবর্তিত রূপ।

তবে অধিকাংশের ধারণা- তান্ত্রিক সাধনা এবং লৌকিক বিশ্বাসকে ভিত্তি করেই এ পূজার প্রচলন। কালের পরিক্রমায়

আনুষ্ঠানিকতার ধরণ এবং ব্যাপ্তি কিছুটা কমে এলেও বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো ঘটা করে চড়ক পূজার আয়োজন করা হয়।

এরমধ্যে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরের ফতেপুরে চড়ক উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে কয়েকশ’ বছর ধরে। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা তার নিচু বর্ণের প্রজাকুলের জন্য এ ধর্মীয় উৎসব শুরু করেছিলেন।

এছাড়া নেত্রকোনার ঋষিপাড়া, সাতপাই, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর শিবমন্দির, শ্রীধরপুর কালীমন্দির, বাহাদুরপুর মন্দির, বরিশালের জুসখোলা, পাবনার পূর্ণানন্দ যোগাশ্রম, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, শিববাড়ি ও গজারিয়াপাড়া, ঠাকুরগাঁও সদরের বুড়াশিব মন্দির, নাটোরের শংকরভাগ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে শত শত বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে চড়ক পূজা।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ সালে চড়ক পূজায় জ্যান্ত মানুষকে বড়শি ও জ্বলন্তবাণবিদ্ধ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আয়োজকরা তাদের ঐতিহ্য ও পূজার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ‘আদিম বর্বরতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ’ ওহয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগজনিত কারণে এসব দৈহিক যন্ত্রণার নানা কলাকৌশল টিকিয়ে রেখেছেন এখনো।  

বাংলাদেশ সময় : ১৫১৩ ঘন্টা, ১৪ এপ্রিল ২০১২
এ কে এম রিপন আনসারী/এআই
সম্পাদনা : আহসান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।