কাওরাইদ(গাজীপুর) থেকে ফিরে : ‘চইত মাসে সারাদিন ক্ষ্যাতে কাম কইরা যহন পানির তিয়াস লাগতো, তহন এই সুইত্যা গাঙের পানি খাইতাম। পানির রঙ এমন আছিল যে, নিজের দেহও দেহা যাইতো।
কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহ জেলার সর্বদক্ষিণের গফরগাঁও উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের সুতিয়া নদীর তীরঘেঁষা পাইথল গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক আব্দুল মান্নাফ।
বছর দু’য়েক আগেও যে নদীতে যখন-তখন ঝাঁপ দিত গ্রামের দুরন্ত কিশোরের দল, যে নদীর সুস্বাদু গোলসা-পাবদা মাছের জন্য ঢাকা থেকে রসনাবিলাসীরা দ্বারস্থ হতেন জেলেদের , সেই নদীর সুনির্মল প্রবাহ আজ হয়ে উঠেছে বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যের ভাগাড়।
ইতিপূর্বে শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকার নদী-নালা, খাল-বিলসহ অন্যান্য মুক্ত জলাশয় অপরিশোধিত বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যের দ্বারা দূষিত হলেও ধীরে ধীরে এই আগ্রাসন পৌছেছে অনেক দূরের নদী-খাল-বিলেও।
আগ্রাসনের শুরু যে ভাবে
শ্রীপুরের বরমী বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদী কিছু দূর গিয়ে ত্রিমোহনী থেকে একটি শাখা উত্তর-পশ্চিম দিকে সুতিয়া নাম ধারণ করে। লাল-এঁটেল মাটির বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই সুতিয়া নদী শ্রীপুর, গফরগাঁও ও ভালুকা হয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলায় গিয়ে শেষ হয়েছে। ময়মনসিংহ ও গাজীপুর জেলার তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকা মূলতঃ এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।
স্থানীয় প্রবীণদের তথ্যমতে, এক সময় এই অঞ্চলের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল কাওরাইদ, গয়েশপুর(গিয়াশপুর) ও বরমী। এসব বড় গঞ্জে যাতায়াতের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল এই সুতিয়া নদী। কেবল নৌ যোগাযোগই নয়, সুতিয়া নদী ছিল তিন উপজেলার মানুষের মাছের অন্যতম যোগানদাতাও।
কয়েক বছর আগেও এই নদীতে পাওয়া যেত সুস্বাদু পাবদা, গোলসা, রিটা ইত্যাদি মাছ। দেশীয় প্রজাতির প্রায় সব মাছই মিলতো এই নদীতে। শুশুকসহ জলচর অন্যান্য প্রাণীদের দেখা মিলতো হরহামেশাই।
দেশের প্রায় সব নদ-নদীর মতোই ক্রমশ: প্রবাহ ক্ষীণ হতে থাকে সুতিয়া নদীরও। তারপরও এক রকম ভালোই ছিল ঐশ্বর্যশালী নদী সুতিয়া ও একে ঘিরে বেঁচে থাকা দুই পাড়ের অধিবাসীরা।
তবে গত দু’তিন বছরের ব্যবধানে শিল্প-কারখানাগুলোর অপরিশোধিত দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিকারক (হেভিমেটাল) তরল বর্জ্য সম্পূর্ণই পাল্টে দেয় নদীর চিরায়ত দৃশ্যপটকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুইপাশে গাজীপুরের শ্রীপুর ও ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় গড়ে ওঠেছে প্রায় অর্ধশত তৈরি পোশাক কারখানাসহ শতাধিক কারখানা। প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুতে কারখানার আশপাশেই তাদের তরল বর্জ্য অবমুক্ত করে আসছিল। পরবর্তী সময়ে গত দু’তিন বছর ধরে এসব কারখানা বহুমাইল দীর্ঘ ড্রেন অথবা মোটা পাইপের মাধ্যমে সরাসরি সুতিয়া নদীতে ফেলতে শুরু করে ক্ষতিকারক তরল বর্জ্য।
শুরুতে ছ’মাস কি বছর পেরুলেও আঁচ করা যায়নি এর ভয়াবহতা। টনকে টন বিষাক্ত তরল বর্জ্য হজম করতে করতে সুতিয়ার এক সময়ের টলমল করা পানি রূপ নেয় দুর্গন্ধযুক্ত রঙ্গিন পানিতে। বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম করে ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারায় ‘সুতিয়া গাঙে’র সকল মৎস্য ও অন্যান্য প্রাণিবৈচিত্র্য।
সম্প্রতি সুতিয়া নদী সরেজমিনে ঘুরে আরো দেখা গেছে, মাছ তো দূরের কথা-একটি ব্যাঙও চোখে পড়ে না নদীর পানিতে। তুরাগের মতই রং ধারণ করেছে অঁজপাড়াগাঁ’য়ের এই নদীর পানি।
কাজে আসছে না কোটি টাকার রাবার ড্যাম
শ্রীপুর, ভালুকা ও গফরগাঁও উপজেলার একটি বিশাল অংশের কৃষি আবাদ মূলত: নির্ভরশীল ছিল সুতিয়া নদীর ওপর। বর্তমানে সচেতন কোনো কৃষকই ব্যবহার করছেন না এই নদীর পানি। অসচেতন ভাবে যারা ব্যবহার করছেন, তাদের অনেকের ক্ষেতেই দেখা দিয়েছে ফলন বিপর্যয়।
অন্যদিকে, এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ কৃষি আবাদের সুবিধার্থে শুষ্ক মৌসুমে সেচ দেওয়ার সুবিধার্থে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা রাবার ড্যাম কোনোই কাজে আসছে না কৃষকদের। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের অর্থায়নে ১৯৯৮ সালে কাজ শুরু করে ২০০০ সালের দিকে এর নির্মাণ শেষ হয়।
শ্রীপুরের কাওরাইদ ইউনিয়নের সুতিয়া নদীতে একটি রাবার ড্যাম এবং একই উপজেলার মাটিকাটা নদীর গোলাঘাট পয়েন্টে নির্মাণ করা হয় অপর একটি ড্যাম। নির্মাণের পর পাঁচ বছরের মতো এ প্রকল্পের সুবিধা পান চাষীরা।
কেবল শ্রীপুর উপজেলা অংশেই প্রায় ৮শ’ হেক্টর জমির এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেচ সুবিধার আওতায় আনা হয়। কিন্তু শিল্পবর্জ্যের আগ্রাসন শুরু হওয়ায় নদীর পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। চরম হুমকির মুখে পড়ে এই অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুতিয়া নদীর তীরবর্তী শ্রীপুর উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর, ধামলই, হয়দেবপুর, সোনাব, বাপতা, বেলদিয়া ও নান্দিয়াসাঙ্গুন, গফরগাঁও উপজেলার পাইথল, ছোটবড়াই ও নিগুয়ারী এবং ভালুকা উপজেলার উড়াহাটি, পারুলদিয়া, ঝালবাজার, পাইলাব, খুর্দ, আশকা, খাওরাইল, বিরুনিয়া, রাজৈ, কাঁঠালী, ধামসুর, মল্লিকবাড়ি, নন্দিপাড়া প্রভৃতি গ্রামের কৃষি আবাদ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যের কারণে।
শ্রীপুরের ধামলই গ্রামের কৃষক আহাম্মদ আলী (৫৫) বাংলানিউজকে বলেন, ‘মিলের লাল পানি ক্ষ্যাতে দেওয়ার পর প্রথমে ধান গাছ ভালোই বড় অইছে। ধান গাছে লম্বা শীষ আইলেও কয়েক দিন পরই দেহি শীষে কোনো ধান নাই, সবই চুচা(চিটা)। ’
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ ফখরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, শিল্পবর্জ্যে থাকা হেভি মেটাল কৃষি আবাদের জন্য সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক। বর্তমানে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা না দিলেও ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে চাষাবাদ হুমকিতে পড়বে।
হুমকিতে জনস্বাস্থ্যও
কেবল কৃষির ক্ষেত্রেই নয়, শিল্পবর্জ্যের কারণে কবলিত এসব অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের অনেকেই এক সময় নিজেদের গোসল সারতেন সুতিয়ার পানিতে। গরু-মহিষকেও গোসল করাতেন নদীতেই।
দূষিত হওয়ার পর থেকে নদীর পানিতে গোসল করে অনেকের শরীরেই বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত নানা রোগেও। বলতে গেলে রোগ-বালাই সারা বছরই লেগে থাকছে এসব এলাকায়।
ভালুকার পারুলদিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল করিম খাঁ (৪৫) বলেন, ‘এই গাঙের পানি দিয়া কিছুই করতারি না। কয়দিন আগে গরুর গা ধূয়ার জন্য নামছিলাম। সারা শইলে ফোসকা পড়ছে। ঔষধ খাওয়ায়েও কিছু অইতাছে না। ’
স্থানীয় সচেতন কেউ কেউ সুতিয়া নদীর দূষণের বিষয়ে ইতিপূর্বে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে অভিযোগ জানিয়েছেন লিখিতভাবে। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন তারা।
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক(মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মুনীর চৌধুরী এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘সংকট উত্তরণের জন্য দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তবে কেবল অভিযান করেই এ আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের শিল্পমালিকদের অতি-মুনাফালোভী মানসিকতা পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন। তাদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত না হলে এ সংকট দূর করা কঠিন। ’
প্রত্যন্ত গ্রামে শিল্পবর্জ্যের আগ্রাসনের বিষয়ে তিনি জানান, এ বিষয়ে দ্রুত খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ সময় : ১৯৫২ ঘণ্টা, ১৭ এপ্রিল ২০১২
এআই / সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।