ঢাকাঃ বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যার নাম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সবার আগে উচ্চারিত হবে, তিনি সত্যজিৎ রায়। কেবল একজন কালোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রনির্মাতাই নন তিনি, তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছে শিল্প-সাহিত্যের অনেক শাখা-প্রশাখায়।
সোমবার পূর্ণ হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর ২০ বছর। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল প্রয়াত হন তিনি। ২০ বছর পরেও সত্যজিতের প্রতিটি চলচ্চিত্রের আবেদন অভাবনীয়! অসম্ভব জীবনধর্মী সত্যজিতের চলচ্চিত্র তাঁর জীবদ্দশাতেই নয়, এই সময়েও মানুষের কাছে সমান আদৃত।
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতা শহরে শিল্প-সাহিত্যচর্চায় প্রাগসর এক বাঙালি পরিবারে। সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী একাধারে লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক, প্রকাশক ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। বাবা সুকুমার রায়ও ছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। ৩ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর মা সুপ্রভা দেবী নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝে বড় করেন সত্যজিৎকে।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে গেলেও চারুকলার প্রতি সীমাহীন অনুরাগ সত্যজিতকে ধাবিত করে শিল্পচর্চার দিকে। এর ধারাবাহিকতায় শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। এখানেই তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে চিত্রকলা বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করেন।
বিশ্বভারতীতে ৫ বছর অধ্যয়নের কথা থাকলেও তার আগেই সত্যজিৎ রায় ১৯৪৩ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে তিনি ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডিজে কিমারে স্বল্প বেতনে জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার পদে যোগ দেন। ১৯৪৩ সাল সত্যজিৎ প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেস-এর বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার কাজ গ্রহণ করেন।
এসময় তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ’পথের পাঁচালী’-র একটি শিশুতোষ সংকলন ’আম আঁটির ভেঁপু’-র প্রচ্ছদ ও ভেতরের বিভিন্ন দৃশ্যপট এঁকে দেন, যা তাঁর পরবর্তী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
১৯৪৯ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোয়া তাঁর ‘দ্য রিভার’ ছবির শুটিং করতে কলকাতায় আসেন। সত্যজিৎ রেনোয়াকে প্রত্যন্ত গ্রামে ছবির লোকেশন খোঁজে দেন। এসময় তিনি রনোয়ারের কাছ থেকে তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা লাভ করেন।
জঁ রেনোয়ার সংগে সত্যজিৎ লন্ডনে গিয়ে ইতালীয় পরিচালক ভিত্তোরিও দ্য সিকার (Vittorio De Sica) ‘লাদ্রি দ্য বিসিক্লেত্তে’ বা ‘সাইকেল চোর’ ছবিটি দেখেন, যা তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। পুরো কর্মজীবনে ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ ঘটে সত্যজিতের।
তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র `পথের পাঁচালী` লাভ করে সর্বমোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শ্রেষ্ঠ মানবদলিল’ পুরস্কার অন্যতম। সত্যজিৎ একাধারে চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা ইত্যাদি বিচিত্র কর্মসম্পাদনের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন নিজেকে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।
বর্ণিল কর্মজীবনে পাওয়া অসংখ্য পুরস্কারের মধ্যে ১৯৯১ সালে পাওয়া সম্মানজনক অস্কার এসবেরেএকটি।
বাংলাদেশ সময়ঃ ০৬০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।