যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এর অনলাইন সংস্করণের গ্লোবাল বিজনেস বিভাগে “In an Unlikely Corner of Asia, Strong Promise of Growth” শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয় গত ২৩ এপ্রিল। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে।
বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য এটির সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন নিউজরুম এডিটর রাইসুল ইসলাম:
বাংলাদেশ এশিয়ার নতুন দিগন্ত যেখানে সমুদ্র সৈকত ঘেঁষা বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্টের বিস্তার সহজেই চোখে পড়ে। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের শহর কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে গড়ে উঠছে এ রকম অসংখ্য হোটেল ও রিসোর্ট।
অনুকূল আবহাওয়ায় কক্সবাজার হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষের ছুটি কাটানোর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত স্থান। শীতের সময় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা না থাকায় ছুটির দিনগুলোতে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত মুখরিত হয়ে ওঠে ইতস্তত ছুটে বেড়ানো শিশু আর তাদের অভিভাবকদের পদভারে।
বঙ্গোপসাগর উপকূলে অবস্থিত এই ছোট্ট শহরে ৫ বছর আগেও বিলাসবহুল হোটেলের সংখ্যা হাতে গোনা যেত। কিন্তু সেখানে এখন গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল আর গেস্টহাউজ।
একটি প্রত্যন্ত সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা থেকে কক্সবাজারের সৈকত নগরীতে পরিণত হওয়া আসলে ১৬ কোটি মানুষের দেশটিতে গত কয়েক বছরে হওয়া উন্নয়নকেই নির্দেশ করছে।
এ ব্যাপারে ঢাকাস্থ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, কক্সবাজারের এই উন্নয়ন বাংলাদেশের অন্যান্য খাতেও অর্জিত উন্নয়নকেই নির্দেশ করে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা এখানে দিন দিন বাড়ছে এবং ক্রমান্বয়ে এটিই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এই উন্নয়ন সত্ত্বেও অন্যান্য উন্নয়নশীল এশীয় রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও ধনী ও গরীবের মধ্যে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। আর এই বৈষম্য আর অস্থিরতা মাঝে মাঝেই সহিংস প্রতিবাদে রূপ নিচ্ছে।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের প্রখ্যাত শ্রমিক-অধিকারকর্মী আমিনুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনাকে। তিনি মূলত শ্রমিকদের নিম্ন বেতন ও কাজের খারাপ পরিবেশের বিরুদ্ধে সচেতনা বৃদ্ধি ও শ্রমিকদের জন্য পরামর্শমূলক কাজ করতেন। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতই ছিলো মূলত তার প্রধান কর্মক্ষেত্র। কিছুদিন আগে তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে তাকে নির্যাতন করা হয় বলে জানা গেছে ময়নাতদন্তে। ধারণা করা হচ্ছে, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সচেতন ও সংগঠিত করার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে হত্যা করে একটি পক্ষ।
এছাড়া বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে দেশের ৭০ শতাংশ জনগণ। কৃষির ওপর নির্ভরশীল এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে। প্রতিবছরই দেশটির নিম্নভূমি প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয় মৌসুমি সামুদ্রিক ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বছরে মাত্র ১০০ কোটি ডলার। যা আলবেনিয়া ও বেলারুশের থেকেও অনেক কম। বিদেশি বিনিয়োগের এই পরিমাণ নিকটবর্তী থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় হওয়া বিদেশি বিনিয়োগের এক দশমাংশ মাত্র।
অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ এবং নড়বড়ে পরিবহন ব্যবস্থা , দুর্বল অবকাঠামো, রাজনৈতিক সংঘাত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতির পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির অভাব এদেশের বিনিয়োগের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তবে এতসব বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশ।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টর্ড ব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি খুব শগগিরই ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এই হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার প্রতি দশকে দ্বিগুণ হবে বলেও ধারণা করছেন তারা।
এইচএসবিসি ব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশ ২৬টি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির দেশের অন্তর্ভুক্ত। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত ও চীনের মত রাষ্ট্র। এই অর্থনৈতিক গতিশীলতা আগামী বছরগুলোতেও পৃথিবীর অনেক অংশের তুলনায় মোটামুটি স্থিতিশীল থাকবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
বৈশ্বিক উৎপাদন উন্নত বিশ্ব থেকে ক্রমাগত কম শ্রমব্যয়ের দেশগুলোতে স্থানান্তরিত হওয়া এই প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। এই ধারাই এশিয়ার অন্যান্য অংশ যেমন চীনকে ৮০ এর দশকের পর থেকে বৈশ্বিক উৎপাদনের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করেছিলো। আর এই ধারাটিই এখন বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করেছে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান উৎপাদন খাত মূলত তৈরি পোশাককেন্দ্রিক। বর্তমানে এর রপ্তানি দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি ডলারেরও বেশিতে। এতে ৩৬ লাখ শ্রমিক সরাসরি জড়িত। দেশটির অর্থনীতির ৭৮ শতাংশ স্থান দখল করে আছে তৈরি পোশাক খাত।
এ ব্যাপারে পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিনসে তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, বহু বছর ধরে বিশ্বের পাইকারি ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে চীন ছিলো সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমা পাইকারি ক্রেতারা বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতের সঙ্গে জড়িতরা চীনের বিকল্পের খোঁজ করছে। নিঃসন্দেহে তাদের জন্য বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১২
সম্পাদনা : রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।