ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অবিশ্বাস্য !

রক্তে রঙিন সাদা কাফন

মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সিএমএম কোর্ট, চট্টগ্রাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৪৬, এপ্রিল ২৫, ২০১২
রক্তে রঙিন সাদা কাফন

বাংলানিউজের নিয়মিত পাঠক চট্টগ্রাম আদালতের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহাবুবুর রহমান। সাহিত্যপ্রেমী মাহাবুবুর রহমান পেশাগত দায়িত্ব বিচারকার্য পরিচালনার পাশাপাশি লেখালেখি করেন, তবে অনিয়মিত।

লাশ বহনকারী গাড়ির এক চালকের কাছ থেকে শোনা বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জবানিতে তিনি ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করছেন বাংলানিউজের পাঠকদের  জন্য ‘অবিশ্বাস্য’ শিরোনামে। যুক্তির তুলাদণ্ডে বিচার আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না গিয়ে আসুন ঘটনাগুলো উপভোগ করি আমরা। এখানে পড়ুন তৃতীয় কিস্তি...

‘রাত বারটা, ঘুমিয়েছিলাম। মোবাইল বাজার শব্দে জেগে উঠি। পুল অফিসের ফোন। জানানো হলো- ভাগ্যমান পেইন্টের (রং কারখানার ছদ্মনাম) মালিক আলীরাজ সাহেব মারা গেছেন। লাশ নিয়ে নোয়াখালী যেতে হবে। বাসা থেকে বের হলাম। পুল অফিস থেকে লাশের গাড়ি নিয়ে আলীরাজ সাহেবের বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত একটা বেজে গেল।

চট্টগ্রাম শহরের একে খান রেলগেটের কাছে বিশাল ছয়তলা বাড়ি। গিয়ে দেখলাম-নি®প্রাণ আলীরাজ সাহেবকে ড্রয়িং রুমে পাটি বিছিয়ে তার ওপর রাখা হয়েছে। সাদা কাপড়ে ঢাকা। ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ছাড়া মৃত ব্যক্তির আশেপাশে কেউ নেই। পরিবারের সদস্যরা যে যার মত করে ব্যস্ত।

ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম, উনাকে গোসল দিয়েছেন?
না-সূচক জবাব শুনে প্রশ্ন করলাম- এই অবস্থায় ফ্রিজে রাখবেন নাকি গোসলের পর রাখবেন?
তিনি বললেন, এতো রাতে হুজুর পাব কোথায়? আমি বললাম- মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেবকে ডেকে আনেন। আমার কথাশুনে ম্যানেজার মুয়াজ্জিন সাহেবকে নিয়ে আসেন। মুয়াজ্জিন সাহেব, ম্যানেজার ও দুই-একজন কর্মচারী মিলে মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়। আশেপাশে পরিবারের সদস্যদের কাউকে দেখিনি।

গোসল শেষ করার পর কাফনের কাপড় খোঁজার জন্য ম্যানেজার বাসার ভিতরে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। ম্যানেজার নাকি জানতেন-তার মালিক হজ্ব করে ফেরার সময় কাফনের কাপড় সাথে এনেছিলেন। কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেল না সেই কাপড়। ম্যানেজার চট্টগ্রাম মেডিকেল এলাকায় গিয়ে গভীর রাতে অনেক কষ্ট করে কাপড় কিনে আনলেন। মুয়াজ্জিনের নির্দেশনা মোতাবেক সেই কাপড় আমরা মৃত ব্যক্তিকে পরিয়ে দেই। কাফন পরানোর পর লাশ গাড়ির ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখি।

রাত তখন তিনটা। আমি ড্রাইডিং সিটে উঠে এসি অন করে ঘুমিয়ে পড়ি। রাত সাড়ে চারটার দিকে ম্যানেজার আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। বললেন, আমার সাহেবের গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে।
আমি বললাম, এ কোন ধরনের অবিশ্বাস্য কথা বলছেন, আপনার মাথা ঠিক আছে তো?

বলতে বলতে আমি ড্রাইডিং সিট থেকে নেমে পড়ি। গাড়ির পেছনে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুলে দেখি ম্যানেজারের কথাই সত্য। টকটকে লাল রক্ত যেন জীবিত কোন মানুষের শরীরে জখম হয়েছে। প্রশ্ন জাগে মনে, এটা কিভাবে হয়। আমি এসব কী দেখছি!

ভোরের আলো ফোটার পর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন আসতে থাকেন। আলীরাজ সাহেবের ছেলেমেয়েরাও আসেন। সবার একটাই কৌতুহল, কেন এত রক্ত বের হচ্ছে? সাড়ে ৮টায় জানাযা পড়ানো হল (ইমামের কথামত লাশের ওপর এক খণ্ড সাদা কাপড় জড়িয়ে দিয়ে জানাজা পড়ানো হয়)।

জানাজা শেষে লাশ গাড়িতে তুলে নোয়াখালীর দিকে রওনা দিই। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও নিকট আত্মীয়দের বহন করে আরো ছয়টি গাড়ি একসঙ্গে যাত্রা শুরু করে। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আমরা ফেনীর মহীপাল পৌঁছলাম। ম্যানেজার আমার পাশের সিটে বসা ছিলেন। ভাত খাওয়ার জন্য দু’জনই নামলাম। ম্যানেজার লাশের অবস্থা দেখতে চান। ফ্রিজ খুললে দেখা যায়- রক্তে একাকার হয়ে গেছে ভেতরটা। যেন রক্তের ওপর ভাসছে লাশটি।

ম্যানেজার আমার কাছে জানতে চান, ‘আমার সাহেবের শরীর থেকে এত রক্ত বের হচ্ছে কেন? এতো রক্ত তো একজন মানুষের শরীরে থাকে না!

জবাবে আমি বলি, ‘আমি অনেক লাশ বহন করেছি জীবনে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা কোনোদিন দেখিনি। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা বলতে পারবেন। ম্যানেজারের চোখেমুখে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল আর আতংকের ছাপ, মুখে কোনো কথা নেই।  

আসরের নামাজের ঘণ্টা খানেক আগে গ্রামে পৌঁছলাম। গ্রামে ‘বড় মিয়া’ বলে পরিচিত দানশীল আলীরাজ সাহেবের জানাযায় অংশ নিতে শত শত মানুষ হাজির। সবার মুখে শুধু এক কথা, এত রক্ত কেন? কী হল বড় মিয়ার!

বড় ছেলে ইমামকে প্রশ্ন করেন, আমার বাবার কাফন কি পাল্টানো যায় না? ইমাম জবাব, না, পাল্টানো যাবে না। তিনি লাল কাপড়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন। বড় ছেলে ইমামের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন।

জানাজা শেষে দাফনের পর বড় ছেলে আবারও মুখোমুখি হন ইমামের। তার মনেও কৌতুহল, কেন এত রক্ত। কেনই-বা তার বাবাকে সাদা কাপড় পড়ানো হল না?

এবার হঠাৎ হুংকার দিয়ে উঠলেন ইমাম, কেমন সন্তান তুমি। বাবার যে সাদা রঙ পছন্দ না সেটাও জাননা। তোমার বাবা ঈদের সময় প্রতিবছর আমার জন্য রঙিন কাপড় পাঠাতেন।

অদূরে একটি এতিমখানা দেখিয়ে তিনি বলেন, এর দেয়ালে আমি সাদা রং করতে বলেছিলাম। তিনি রেগে গিয়েছিলেন। আমাকে বলেছেন, সাদা রংয়ের কাপড় পড়ে তিনি কবরেও যেতে চান না। সাদা রংয়ের প্রতি ছিল তার এমনই বিতৃঞ্চা।

আমি শুনলাম, ভালভাবে, নিবিড়ভাবে শুনলাম আর মনে মনে বললাম, এও কী সম্ভব!

বাংলাদেশ সময় : ১২৪২ ঘণ্টা, ২৫ এপ্রিল, ২০১২

সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।