ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অনেক তাকানো হলো, আসুন এবার দেখি

গ্রন্থনা ও ভূমিকা : শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:২৬, এপ্রিল ৩০, ২০১২
অনেক তাকানো হলো, আসুন এবার দেখি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা উৎকন্ঠা আর উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইছেন- আমাদের ফেলে আসা প্রাণের আঙিনা কেমন আছে?

যখন তারা গণমাধ্যমে দেখে প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। তখন তারা ব্যথিত হন, ক্ষুব্ধ হন।

তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়তে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন সকল ক্ষমতাবলে টিকে থাকার কথা বলেন, তখন দেশের শিক্ষানীতিতেও প্রশ্নবিদ্ধ হয় ‘শিক্ষকনীতি’।

জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বাংলানিউজের কাছে প্রকাশ করেছেন তাদের ক্ষোভের কথা, দাবির কথা এবং বেদনার কথা।

Arkoঅর্ক,  প্রাক্তন জাবি শিক্ষার্থী, সঙ্গীত পরিচালক

ছাত্র শব্দটি নাকি ছত্র, মানে ছাতা থেকে এসেছে, আর শিক্ষা-শিক্ষাগুরু থেকে শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের তৃষ্ণা ভক্তি-প্রেমে শিক্ষাগুরুর মাথায় ছাতা ধরতেন, আর গুরু শিষ্যের মাথায় তার হাত রেখে জীবনবোধের শিক্ষা দিতেন।

কালে কালে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। ইতিহাসের অসংখ্য চোরাগলি পেরিয়ে, অনেক ঝড়তুফান-ভাঙ্গাগড়া সামলে, আজ ২০১২ সালের আধুনিক বাংলাদেশের খবর, প্রধানশিক্ষকের ইন্ধনে কতিপয় শিক্ষার্থী(!) একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতিকর্মী সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের লাঠি-রডপেটা করে অর্ধমৃত করেছে, গুরুভক্তির তাড়নায় এই ধ্বংসযজ্ঞে তারা, প্রগতিশীল শিক্ষকদেরও পেটাতে ছাড়েনি। বাহ, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুর কী শিক্ষা, আর কী’ই না গুরুভক্তি!

আইন ও বিচার নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার সাহস এরা কেথায় পেল, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভিত্তিক রাজনীতিতে তার সব উত্তর আছে।

প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয়শিক্ষার্থী বন্ধুরা, ছাএলীগ-ছাএদল বা ক্ষমতাশীন যে কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থের রাজনীতি কতটুকু করে, তা ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেকবার প্রমাণ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ব্যক্তিগত অবৈধ স্বার্থে, কখনো দলীয় নেতার অথবা কখনো দলীয় প্রভাবশালী ভিসি-প্রক্টর পদস্থ তথাকথিত শিক্ষকদের গোলামী করে শিক্ষাঙ্গনে নিজেদের প্রভুত্ব টিকিয়ে রেখেছে। পাশাপাশি ধ্বংস করছে সুশিক্ষার পরিবেশ, সুখ-সম্প্রীতি এবং আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের সংস্কৃতি।

আমরা মনে করি, নিজেদের অধিকার অর্জনের সময়, সবসময়ের মতই- এখনই। যে ভিসি, ছাত্র-রাজনীতির নামে শিক্ষার্থীদের টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী, খুনখারাবি শেখায়; একজন সন্ত্রাসী সিকিউরিটি অফিসারকে দিয়ে ক্যাম্পাসের পুরোনো গাছের ব্যবসা করায়, তার উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য তথা পুরো জাতীর জন্যই হুমকির।

মুখবুজে অন্যায় সহ্য করা বা কারো সাতে-পাঁচে নাই, চরিত্র ধারণও আমাদের মতে এক ধরণের ‘যুদ্ধপরাধ’। তাই ক্যারিয়ারিস্ট মনোভাব ভেঙ্গে, শিক্ষাঙ্গনে উপযুক্ত জ্ঞানচর্চার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লড়াই, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদেরই। সত্যের যে কোনো ধরনের যুথবদ্ধতা, বিরাট অসত্য-অপশক্তিকে রুখেদেয়, এটাই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক শক্তি।

বন্ধুরা, চারপাশে অনেক তাকানো হলো, এবার দেখার পালা সুরের সামনে অসুরের পতন।

২৮এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক জোটের নেতা-কর্মী ও সংস্কৃতিমনা শিক্ষকদের ওপর বর্বরচিত হামলার সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকের বিচার চাই।


Oveeঅভী চৌধুরী, জাবি প্রাক্তন শিক্ষার্থী, প্রভাষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমানে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অত্যন্ত মর্মান্তিক। যেভাবে আমার শিক্ষক ও ছোট ভাইদের ওপর হামলা হচ্ছে তা নিয়ে আমি শংকিত। আমি মনে করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি হুমকির মুখে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক জোটের ওপর যে হামলা হয়েছে তার তীব্র নিন্দা আমি জানাই। একই সঙ্গে উপচার্যের হঠকারি সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। তার ওপর সিন্ডিকেট গ্রীষ্মকালীন ছুটি একমাস এগিয়ে নিয়ে এসেছে। যা আরও হঠকারিতার প্রমাণ বহন করে। শিক্ষার পরিবেশ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে উপাচার্যের উচিত পদত্যাগ করা।

Nur-নূর সিদ্দিকী: জাবি সাবেক শিক্ষার্থী  ও সাংবাদিক

ন্যায় আর দাবি আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি উপযোগী স্থান। শিক্ষার্থীরা বরাবরই বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, নির্যাতিতও হয়েছে বারবার। কিন্তু এবারের এই আন্দোলনে যেভাবে শিক্ষকরা শিক্ষকদের মারধর শুরু করেছেন তাতে মনে হয়, যারা এসব করছেন তারা তাদের অবস্থান ভুলে গেছেন।

শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আ আ মামুন যখন কেঁদে কেঁদে বলেন তাকে তারই সহকর্মীরা মেরেছেন কিংবা সাবেক প্রক্টর মোহম্মদ আলী আকন্দ মামুন যখন একই কথা বলেন, আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং থানায় মামলাও করেন তখন শিক্ষকদের নৈতিক অবস্থান সম্পর্কে কেবল জিজ্ঞাসাই বাড়তে থাকে।

যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষক-খুনি-জামাত-শিবিরকে ছাত্র-ছাত্রীরা বিতাড়িত করতে পারে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ভিসি নিজেকে চিরকালের জন্য স্থায়ী ভাববেন এটা আকাশ-কুসুম কল্পণা ছাড়া আর কিছুই নয়। যেসকল শিক্ষক বর্তমান ভিসির পদত্যাগের দাবি তুলছেন তাদের সংখ্যা কম হলেও নৈতিকতা ও যৌক্তিকতার প্রশ্নে কিন্তু তাদের দলই ভারী। বর্তমান ভিসি কোন শক্তিবলে আন্দোলনকারী শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী-সংস্কৃতি কর্মীদের ওপর সন্ত্রাসী লেলিয়ে দেন তা স্পষ্ট নয়।

এই ভিসি হয়তো ভুলে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাসের কথা। মজার বিষয় হলো ভিসিপন্থি কিংবা ভিসি বিরোধী দুই পক্ষেই আছেন, আওয়ামী-বিএনপি-জামায়াত-বামপন্থি শিক্ষকরা। ফলে নিজেদের দলীয় স্বার্থের ঊর্দ্ধে উঠে যখন তারা আলাদা শিবিরে বিভক্ত হতে পারেন তখন আর বলার অপেক্ষাই থাকে না যে, শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় তারা কতটা ভূমিকা রাখবেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষকরা যে আটদফা দাবি তুলেছেন তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে একদিনের জন্যও যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত করতে না চান তাহলে তো ভিসির পদত্যাগের ঘটনা ঘটতো আরও দুইমাস আগেই।
জুবায়েরই প্রথম নয়, আরও যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হয়েছেন কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার কিন্তু হয়নি এবং প্রতিবারই ভিসি নিশ্চয় বলেছেন, আমার মত ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত কেউ নেয়নি। শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার প্রশ্নটিকে সবার্ধিক গুরুত্ব শিক্ষকরা কেন দিচ্ছে না সেটাই বড় প্রশ্ন। তারা কি কেবল চাকরিই করছেন না কি জ্ঞান আর ‍আলো বিতরণের জন্য শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন খুব জানতে ইচ্ছে করে। দুনিয়ায় তো আরও অনেক চাকরি আছে..

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই আছে অনেক রকম প্রতিষ্ঠান হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল-গাঁধার খামার। কিংবা সামান্য দূরে গেলে ইপিজেডেও লোকজন চাকরি করে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই অন্য কিছুই নয়। যারা গুণ্ডা দিয়ে প্রশাসন চালাতে চান তারা শিক্ষক নন।

Salauddinসালাহ উদ্দিন শুভ্র, সাংবাদিক

যে কোনোভাবেই শরীফ এনামুল কবির উপাচার্য হিসেবে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এ আসনের মর্যাদা তিনি আবর্জনায় নামিয়ে এনেছেন।

খুন, মারামারি, দখলবাজি- এসবের দেখাশোনাতেই তিনি ব্যস্ত ছিলেন বলে মিডিয়ার খবর দেখে অনুমান হয়। উন্নয়ন মানে যিনি দালান নির্মাণ বোঝেন, তিনি আর যাই হোন উপাচার্য হবার মত বুদ্ধি রাখেন না।

কথাবার্তায় মনে হয় তিনি কোনো বারোয়ারি বাজারের ঠিকাদারি নিয়েছেন। সেখানে পর্যাপ্ত ‘দোকান’‌ বসানো গেছে কিনা এটাই দেখেন। আর মাস্তান পোষেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন মাস্তান পোষেন, তখন আসলে বলার কিছু থাকে না।

ওনার বিরুদ্ধে যে সমস্ত শিক্ষক আন্দোলন করছেন, তাদের বিষয়েও সাবধান থাকাই শ্রেয়। সাবধান থাকতে হবে শিক্ষার্থীদের। কারণ তাদেরই লাশ পড়ে, তারাই সেশনজটে পড়ে। তাদের কন্ঠ সবসময় সোচ্চার থাকা চাই। যে কোনো গুণ্ডা এবং তাদের প্রতিপালক উপচার্য ও প্রশাসনকে সবসময় হুমকির মধ্যে রাখতে হবে। এটা আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার দায়। শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে যতবার ভুল করবে, ততবার তারা লাশ হবে বা পঙ্গু হবে।

বাংলাদেশ সময় : ১৩০৩ ঘণ্টা, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

ahsan@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।