ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

চিরবঞ্চিত চা শ্রমিকদের জীবনগাথা

ফেরদৌস আহমেদ, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:১৭, মে ১, ২০১২
চিরবঞ্চিত চা শ্রমিকদের জীবনগাথা

মৌলভীবাজার: তাদের শরীরের ঘাম ও হাড়ভাঙা খাটুনির ওপর ভর প্রায় দু’শ বছর ধরে টিকে রয়েছে এদেশের চা-বাগান তথা চা-শিল্প। কিন্তু সেই চা শ্রমিকরা আজও মৌলিক অধিকারবঞ্চিত।



দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বললেই ব্রিটিশ আইনে ধরিয়ে দেওয়া হয় অভিযোগপত্র। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বংশানুক্রমে তারা চা বাগানে বাস করে। তাদের জন্ম ও মৃত্যু হয় চা বাগানেরই মাটির জীর্ণ কুটিরে।

চা শ্রমিকরা বাগানের ভাষায় কুলি হিসেবে পরিচিত। এ জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস ভারতের মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে। ব্রিটিশদের মাধ্যমে এ দেশে তাদের আগমন ঘটে দেড় শতাধিক বছর আগে।
 
চা শ্রমিকদের নেই নিজস্ব বসতভিটা বা এক খণ্ড জমি। বছর ঘুরে মে দিবস আসে, আবার চলে যায়; কিন্ত চা শ্রমিকরা তাদের মৌলিক অধিকারটুকু এখনও অর্জন করতে পারেনি।

চা শ্রমিকদের মান উন্নয়নের জন্য তৈরি শ্রম আইন কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। শ্রম আইনের ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের সব শ্রেণির শ্রমিক নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করলেও শ্রম আইনে চা শ্রমিকদের এ সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের ত্যথানুযায়ী জেলার মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ চা জনগোষ্ঠী। তারা সংখ্যায় ৬ থেকে ৭ লাখ। সঙ্গে রয়েছে আরও ১৭ টি নৃ-জনগোষ্ঠী, যাদের অধিকাংশই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।

বিশাল এ জনগোষ্ঠী শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণে এ জেলাও শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে।

চা শিল্পের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত শ্রমিকরা অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা, বিনোদন ও মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। এরা অস্থায়ী নিয়োগপত্রে কাজ করে থাকে। নেই সার্ভিস রুল, ওভার টাইম মজুরি।

বাগান ব্যবস্থাপনায় ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইন কানুনের কোনো পরিবর্তন হয়নি এখনও। কাজের ক্ষেত্রে এদের দফাওয়ারি হিসাব হচ্ছে পুরুষ ‘মর্দনা’ এবং মহিলা ‘রেন্ডি’। ইংরেজদের প্রচলিত এই শব্দগুলো আজও চালু রয়েছে।

শ্রমিকরা মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত হলেও বাগানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, সহকারী ব্যবস্থাপক এমনকি টিলা বাবুরা পর্যন্ত ভোগ করেন স্বর্গীয় সুখ। পানির গ্লাস এগিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সাহেবদের জুতোর ফিতা পর্যন্ত খুলে দিতে হয় এদের।

দিনভর চা শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাদের দৈনিক মজুরি ৩০ টাকা ২৬ পয়সা। এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ইংরেজদের রীতিতেই তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় অভিযোগপত্র। অথচ চায়ের দাম দিন দিন বেড়ে গেলেও বাড়েনি তাদের মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা।

চা শ্রমিকদের নিজস্ব সম্পদ বলতে ছেঁড়া চট, টিনের মগ ও থালা বাটি। বাগানের ভেতর রাস্তার দু’পাশে ছনের চালা আর মাটি দিয়ে তৈরি ৮ হাত প্রস্থ ও ১২ হাত দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এক একটি ঘর তাদের তিন পুরুষের ঠিকানা।

একসাঙ্গে মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী নিয়ে তাদের জীবন। প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাদের ঘরের দৈর্ঘ্য।

আলো বাতাসহীন ঝুপড়ি ঘর, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিকদের রোগব্যাধি লেগেই থাকে। তাদের সন্তানরা ভুগছে পোলিও, ম্যালেরিয়া, হাম, রাতকানা রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে। এরা চা গাছের নিচে, ডোবা আর ঝোঁপ-ঝাড়ে মলমূত্র ত্যাগ করে থাকে। স্যানিটেশনের ন্যূনতম সুবিধাও পায় না তারা।

অধিকাংশ চা বাগানে শিক্ষার আলো বা সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষার স্লোগান পৌঁছেনি। সারা জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনেচ্ছু অর্ধ-লক্ষাধিক চা শ্রমিক শিশু ও কিশোর রয়েছে। যে সব বাগানে নামেমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেক বিদ্যালয়ই সরকারি হয়নি বা রেজিস্ট্রেশন পায়নি।

বাগানের বিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা বাগান কর্তৃপক্ষের হাতে থাকায় অধিকাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হাজিরা খাতায় উপস্থিতির স্বাক্ষর নিশ্চিত করে বাকি সময় বাগানের অফিসে অথবা বাগানে কাজ করেন। যখন ইচ্ছে তখন বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু ও ছুটি হয়। নেই পর্যাপ্ত বেঞ্চ ও ডেস্ক।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্রমতে, দেশের ১৫৮টি চা বাগানে জনসংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ। এর মধ্যে ২ লাখ ৭৫ হাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও বৃদ্ধ।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আগে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল যথাক্রমে ২৬, ২৮ ও ৩০ টাকা। বর্তমানে তা বাড়িয়ে প্রথম শ্রেণীর বাগানে ৪৮ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর বাগানে ৪৬ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণীর বাগানে ৪৫ টাকা করা হয়েছে।

এছাড়াও প্রতি সপ্তাহে জনপ্রতি ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম আটা দেওয়া হয়। আগে বাৎসরিক বোনাস ছিল ৫০০ টাকা। এখন তা বেড়ে ১ হাজার ২৪৮ টাকা হয়েছে। শ্রমিক পরিবারে গড় জনসংখ্যা ৭ জন। হিসেব করলে দৈনিক প্রত্যেকের ভাগ্যে জোটে সোয়া সাত টাকা করে।

ফলে বেকার চা শ্রমিকদের অধিকাংশরা বেছে নিচ্ছে ইটভাঙা, রিকশা চালানো, কাঠমিস্ত্রির কাজ, চা কারখানা থেকে তৈরি চা পাতা পাচার, কচি চা পাতা তুলে অবৈধভাবে প্রক্রিয়াজাত করা, বাগানের ছায়াবৃক্ষ চুরি, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে পাচার ইত্যাদি।

চা বাগানগুলোতে কীটনাশক ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও মালিকপক্ষ সে নিয়ম মানছে না।

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চা সংসদ ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ৯(ক) ধারা মতে- চা বাগানের যে সব শ্রমিক বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ছিটানোর কাজে জড়িত থাকবে, তাদের প্রত্যেককেই শরীরের প্রতিরোধ পোশাক কর্তৃপক্ষ দেবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর সুফল পায়নি চা শ্রমিকরা।

ফলে চা শ্রমিকরা হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট পরে বা খালি গায়ে কোনো মুখাবরণ ছাড়াই রাসায়নিক ছিটিয়ে থাকে। এ কারণে মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, নাক-কান জ্বালা পোড়া এমনকি হৃদকম্পন, শ্বাসকষ্ট, শরীর কাঁপা, বমিভাবসহ অসংখ্য শারীরিক সমস্যা তাদের নিত্যসঙ্গী।

অপরদিকে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ চা বাগানগুলো নিয়মিত পরিদর্শন না করায় শ্রম আইন পুরোপুরি লঙ্ঘিত হচ্ছে। পদ মর্যাদার অবস্থান, বিভাগীয় লোকবল, অর্থ বরাদ্দ ও আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিয়োজিত শ্রম পরিদর্শন বিভাগ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

চা বোর্ড সূত্র জানায়, ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান্ট ফর টি ইন্ডাস্ট্র্রি অব বাংলাদেশ ভিশন ২০২১’ নামের একটি প্রকল্প চায়ের উৎপাদন ১০০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করতে হাতে নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের ১২ দফা প্রস্তাবগুলোর মধ্যে শ্রমিকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ ও শ্রমিক ওয়েলফেয়ার ফান্ড গঠন ও চা শ্রমিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, বসতভিটা উন্নয়নে কোনো নির্দিষ্ট সুপারিশের কথা বলা হয়নি। বরাবরের মতো এবারও প্রকল্পে চা শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়নের কোনো প্রস্তাবনা নেই।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বাংলানিউজকে জানান, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা চাওয়া হয়েছে। বছরে বোনাস ৯ হাজার টাকাসহ বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি তাদের দাবি।

এছাড়া স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ, বসতভিটার অধিকার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ইত্যাদি দাবি বাগান মালিক ও সরকারের কাছে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১২

প্রতিবেদন: ফেরদৌস আহমেদ ; সম্পাদনা: রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর/শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম এডিটর / সাইফুল ইসলাম, কান্ট্রি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।