প্রয়াত শহীদ জননী জাহানারা ইমাম-এর ৮৩তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী বাংলানিউজ-এ তার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি তর্পণ করেছেন। ধন্যবাদ বারী ভাইকে, তার এ লেখাটির জন্য।
লেখাটি পড়তে গিয়ে আমি নিজেও বার বার ফিরে যাচ্ছিলাম অতীতে। আমি তখন (১৯৯২) অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক ভোর’ নামক একটি পত্রিকায় শিক্ষানবীশ সাংবাদিক হিসেবে মাস দু’য়েক হলো কাজ শুরু করেছি। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ জননীকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার। খুব বেশি অসুস্থ না থাকলে প্রায় সব কর্মসূচীতেই উপস্থিত থাকতেন তিনি। যতবার-ই তাঁকে দেখতাম মনে হতো, মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস করেও কী অসীম দৃঢ়তায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে পুলিশি নির্যাতন থেকেও রেহাই পাননি অসুস্থ এ বর্ষীয়ান জননী।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ছাব্বিশে মার্চ (১৯৯২) গণআদালতের কর্মসূচিকে সামনে রেখে একটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে। মার্চের ১ তারিখ থেকে ‘ডেটলাইন ২৬ মার্চ : আর মাত্র ২৫ দিন’ এ ধরনের একটি শিরোনাম ব্যবহার করে প্রতিদিন-ই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ বা মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হতো। ছাব্বিশে মার্চ গণআদালতের দিন দৈনিক ভোর-এ সেটা ব্যানার হেডলাইন করা হয়েছিল।
গণআদালতের রিপোর্ট সংগ্রহে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওইদিন আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেটা অবশ্যই এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকার পতনের দিন সারাদেশে যে ঐক্য ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল, প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়েছিলÑ এটিও সে রকম একটি ঐতিহাসিক দিন। কিন্তু এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব ছিল আরো ব্যাপক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেদিনের বিশাল জনসমুদ্রের কথা বারী ভাই লিখেছেন, আমি সেদিকে যাচ্ছি না। পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ।
দেশের বরেণ্য ১২জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে গণ আদালত গঠন করা হয় এবং জাহানারা ইমাম ছিলেন এর চেয়ারম্যান। গণআদালতের এ ১২জন বিচারকের মধ্যে ছিলেন- অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাযহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান, লে. কর্নেল (অব) কাজী নূর-উজ্জামান, লে. কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী ও ব্যারিস্টার শওকত আলী খান। এদিনের এ গণআদালতে জামায়াতের শীর্ষ নেতা গোলাম আজমের প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠিত হয়। আদালতে গোলাম আজমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দশটি অভিযোগ উত্থাপন করে বলা হয়, তার এ দশটি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য।
এখানে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যে কথাটা উল্লেখ না করলেই নয়, সেটা হচ্ছেÑ সেদিন কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে কিছু বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালিয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদপুষ্ট ও তাদের আদর্শের ধারক-বাহক কয়েকটি পত্রিকা অফিস ভবনে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সংগ্রাম ও ইনকিলাব। এ পত্রিকা দু’টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গণআদালত ঠেকানোর জন্য জাহানারা ইমাম ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র নেতৃবৃন্দসহ এর সঙ্গে যুক্ত দেশের বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র হননে উঠেপড়ে লেগেছিল। প্রকাশ্যে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করা হয়েছিল কাউকে কাউকে।
গণআদালত অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাহানারা ইমামসহ দেশের ২৪জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে জামিন-অযোগ্য মামলা দায়ের করে বিএনপি সরকার। পরবর্তীতে হাইকোর্ট অবশ্য তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।
গণ আদালতের রায় কার্যকর করার দাবিতে এরপর ১২ এপ্রিল (১৯৯২) জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১শ’ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায় কার্যকর করার বিষয়টি সমর্থন করলে বেকায়দায় পড়ে যায় সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ৩০ জুন সংসদে চার দফা চুক্তি করে সরকার। পরবর্তীতে এ চুক্তি আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ‘গণতদন্ত কমিশন’ আরো ৮জন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করে। অভিযুক্ত এই ৮জন যুদ্ধাপরাধী হলেন- জামায়াত নেতা আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও আবদুল কাদের মোল্লা। আর ‘গণতদন্ত কমিশন’-এর সদস্য ছিলেন- কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান, বিচারপতি কেএম সোবহান, সালাউদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদ, কবি শামসুর রাহমান, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আবদুল খালেক ও সদরুদ্দিন।
উল্লেখ্য, গণআদালতের সম্মানিত বিচারক ও ‘গণতদন্ত কমিশন’-এর সদস্যদের অনেকেই এখন আর জীবিত নেই।
১৯৯৪ সালের এপ্রিলে চিকিৎসার জন্য শেষবারের মতো দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ জাসদ কার্যালয়ের কর্নেল তাহের মিলনায়তনে নির্মূল কমিটির এক আলোচনাসভায় এসেছিলেন জাহানারা ইমাম। তবে এবার বিদেশে গিয়ে তিনি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে স্বহস্তে লিখিত ‘দেশবাসীর প্রতি আমার আহবান ও নির্দেশ’ শীর্ষক এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান তিনি। শহীদ জননীর মৃত্যুর পর নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হাতে লেখা তাঁর সেই শেষ বিবৃতির ফটোকপি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়েছিল। বিবৃতিতে জাহানারা ইমাম লেখেন-
“সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ, আপনারা গত তিন বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আপনাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা, আমার সন্তান-সন্তুতিরাÑ আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।
এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি, জনগণের মতো বিশ্বস্ত কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলমি। জয় আমাদের হবেই।
এ মহীয়সী ও সাহসী জননীকে নিয়ে এ সময়ে আরো বেশি লেখালেখি হওয়া দরকার। বিশেষত: দেশে এখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার কার্যক্রম চলছে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ঘাতকদের এ বিচারের দাবির আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই এ আন্দোলন এগিয়ে যায়। তাঁর আপসহীন ও অ-রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি সে সময়ে দলমত নির্বিশেষে জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশের সচেতন সাধারণ মানুষ সবসময়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রত্যাশী ছিল, কিন্তু তারা সংগঠিত ছিলেন না। দলমত নির্বিশেষে সারাদেশের মানুষকে সংগঠিত করার এ দুরূহ কাজটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পাদন করেছিলেন জাহানারা ইমাম।
লেখক : সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলাদেশ সময় : ০৪২৬ ঘন্টা, ০৫ মে, ২০১২
এসআর/ সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan@banglanews24.com