ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে...

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৩১, মে ৮, ২০১২
পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে...

ঢাকা: ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে’ একটি অসম্ভব জনপ্রিয় বাংলা গান। হৃদয়স্পর্শী এই গান যিনি গেয়েছেন, তিনি আমাদের সকলের প্রিয় শিল্পী কলিম শরাফী।

সুদীর্ঘ সংগীত জীবনে এমন বহু কালজয়ী গান তিনি উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য।
 
৮ মে মঙ্গলবার প্রিয় শিল্পীর ৮৯তম জন্ম দিন। মাত্র ২ বছর আগে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া এই শিল্পী এখনো বেঁচে আছেন লাখো ভক্ত অনুরাগীর মাঝে। প্রতিথযশা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী-এই পরিচয়ের বাইরেও তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
 
যে ভাবে বেড়ে ওঠা: কলিম শরাফীর পুরো নাম মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী। ১৯২৪ সালের ৮ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি সদর মহকুমার অন্তর্গত খয়রাদিহি গ্রামে তার জন্ম। পিতা সামি আহমেদ শরাফী ও মাতা আলিয়া বেগম। মাত্র চার বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ ঘটে কলিম শরাফীর। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া কলিম শরাফীর পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় আরবি ওস্তাদজী আর বাংলা পণ্ডিত মশাইয়ের হাতে।

প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে কলিম শরাফী কলকাতায় বাবার কাছে চলে আসেন। সেখানে ১৯৩৫ সালে ভর্তি হন মাদ্রাসা-ই-আলিয়াতে। অ্যাংলো পার্শিয়ান বিভাগে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কলকাতার বিখ্যাত সংগীত বিদ্যালয় ‘দক্ষিণী’ থেকে ১৯৪৬-১৯৫০ সাল পর্যন্ত সংগীত শিক্ষা লাভ করেন তিনি।

১৯৬৪-৬৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান টেলিভিশনে অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর ১৯৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান গ্রামোফোন কোং লিঃ এর পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৭৪-৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন এর প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ও মহাব্যবস্থাপক পদেও দায়িত্ব পালন করেন।
 
১৯৪৪ সালে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে (আইপিটিএ) যোগ দিয়ে কলকাতার হাজারা পার্কে সর্বপ্রথম গণসংগীত পরিবেশন করেন কলিম শরাফী। এরপর ১৯৪৬ সালে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে বের হয় কলিম শরাফীর প্রথম গণসংগীতের রেকর্ড, একই সময়ে তিনি নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কলকাতা বেতারে।
 
গুহঠাকুরতার রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান `দক্ষিণী`তে নিয়মিত রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন, পরবর্তী সময়ে কলিম শরাফী এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানেই তিনি দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র প্রমুখের সাহচার্য লাভ করেন।
১৯৫৭ সালে আকাশ আর মাটি চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্র সংগীত গান। ১৯৫৮ সালে কলিম শরাফীর গান রেডিওতে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার। স্বাধীনতা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিলো।
 
‘সূর্যস্নান’ ছবিতে ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে...’ গানটি গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন কলিম শরাফী। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় প্রথম টেলিভিশন স্টেশন চালু হলে তিনি সেখানে অনুষ্ঠান পরিচালক পদে যোগ দেন। কলিম শরাফী ১৯৬৯ সালে সত্যেন সেনের সঙ্গে উদীচীর কর্মকাণ্ডে যোগ দেন এবং ১৯৭৭ থেকে দীর্ঘ সময় সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৩ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘সঙ্গীত ভবন’ নামে একটি সংগীত বিদ্যালয়। ‘স্মৃতি অমৃত’ তার প্রকাশিত গ্রন্থ। তার গানের পনেরোটি ক্যাসেট ও তিনটি সিডি প্রকাশিত হয়েছে।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী কলিম শরাফী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কাউন্সিল ও শিশু একাডেমি কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ বেতার টিভি শিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সংস্থা ও নাগরিক নাট্য অঙ্গন-এর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
 
কলিম শরাফীর বিখ্যাত গানের অ্যালবামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এই কথাটি মনে রেখো, আমি যখন তার দুয়ারে, কলিম শরাফীর যত গান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথা ও সুরে নবজীবনের গান।
 
কৈশোরে কলিম শরাফী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। পরবর্তী সময়ে গান্ধীজীর ভারত ছাড় আন্দোলনেও অংশ নেন তিনি। কমরেড মোজাফফর আহমেদের সংস্পর্শে এসে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনেও যুক্ত হন। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময় তিনি কারাভোগ ও নিপীড়নের শিকার হন।

৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করার কাজে অংশ নেন কলিম শরাফী। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণআদালতে সম্পৃক্ত থাকার কারণে ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় তাকে আসামি করা হয়।

স্বীকৃতি: দীর্ঘ জীবদ্দশায় সংগীত সাধনা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কলিম শরাফী একুশে পদক (১৯৮৫), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণ পদক (১৯৮৮), বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণ পদক (১৯৮৭), সত্যজিত রায় পুরস্কার (১৯৯৫) এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের ‘কৃতি বাঙ্গালী সম্মাননা পদক’ (১৯৮৮) লাভ করেন।

এছাড়া বাংলা একাডেমী ফেলোশিপ, রবীন্দ্র সুবর্ণ জয়ন্তী পাটনা, কলিকাতার শিল্প মেলার বঙ্গ সংস্কৃতি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অ্যাওয়ার্ড, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গুনীজন সংবর্ধনা, পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৫তম জন্ম বার্ষিকী সম্মাননা, ডি-৮ আর্ট অ্যান্ড কালচার ফেস্টিভেল সম্মাননায় ভূষিত হন। সর্বশেষ তিনি বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত ‘রবীন্দ্র পুরস্কার-২০১০’ এ ভূষিত হন। ২০১০ সালের ২ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সংগীতের এই কালজয়ী শিল্পী।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১২
এআই/সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।