শ্যামনগরের পাতাখালি গ্রাম থেকে: ‘ঘর ভাঙা কি কষ্ট তা আমরা জানি। তাই কেউ উগো (ওদের) ঘর ভাঙতে আসলি আমরা তাগো (তাদের) তাড়িয়ে দেই।
শ্যামনগরের গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। সঙ্গে বাংলানিউজের স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নাজমুল হাসান।
সুন্দরবন ঘেঁষা এই জনপদে মোটর সাইকেল একটি প্রধান বাহন। চালকের পেছনে চড়ে যাত্রীরা পথ পাড়ি দেন। আমরা একটি মোটর সাইকেলই ভাড়া করে নিয়েছি। নাজমুল ভাই দক্ষ চালক। আমি তার পেছনে একমাত্র যাত্রী। এখানে সেখানে হাত তুলে অনেকেই থামাতে চান যাত্রী হওয়ার আশায়। একজনমাত্র যাত্রী নিয়ে মোটর সাইকেল এখানে চলে কম। বিষয়টিতে বেশ মজা পেয়েছেন নাজমুল ভাই। আমিও উপভোগ করছি। কিন্তু পাঠকের কাছে মোটর সাইকেলের গল্প নয় পাখিদের গল্প জানাতেই এ রিপোর্ট।

থেমে যায় নাজমুল ভাইয়ের মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেল চলার সময় নাজমুল ভাইয়ের ক্যামেরাটির বাহক আমি। দ্রুত ক্যামেরা এগিয়ে দিলাম। বলার আগেই বের করলাম প্রয়োজনীয় লেন্স। ( কয়েকদিন তার সঙ্গে কাজ করে বুঝে গেছি কোন ছবিতে কোন লেন্সের প্রয়োজন)। এগিয়ে দেওয়া লেন্সটি নিয়ে দ্রুত লাগিয়ে নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেন। আর রাস্তার পাশে মুগ্ধ চোখে বসে পড়ি আমি। দেখতে থাকি পাখিগুলোর গতিবিধি।
কোনটি মগডালে বসে আছে, কোনটি উড়ছে। কোনোটি উড়ে গিয়ে নামছে চরে। ছোটাছুটি করছে সেখানে, কোনোটি খাবার খুঁজছে। গাছের ডালে বসেও চলছে ঝগড়া, খেলা আর ওড়াউড়ি। ঐ এলাকা মুখরিত তাদের কলতানে। এ যেন বকেদের রাজ্য।
এমন সময় রাস্তার পাশের বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসে রেশমা।

আমাদের পরিচয় দিয়ে দ্রুত তাকে আশ্বস্ত করলাম, ``পাখি মারব না ছবি তুলবো। ``
আমাদের নিরাপদ ভেবে রেশমা এবার রাস্তার পাশেই আমার বসার ব্যবস্থা করল। তার দেওয়া মাদুরে বসেই লিখছি এই প্রতিবেদন।
নাজমুল ভাই তখনও ব্যস্ত গাছে থাকা পাখিদের মমতা, প্রেম-ভালবাসা, আর দুষ্টুমি ক্যামেরাবন্দি করতে।
রেশমা জানালো আইলার পর ঘরবাড়ি হারিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে একটি এনজিও তরফ থেকে দেওয়া ঘরটিতে আশ্রয় নেয় তারা। আর তখন থেকেই দেখছে এই পাখিগুলোকে।
রেশমার বক্তব্য, “আমরা সব হারিয়ে ইকিনে (এখানে) আইছি। ওরাও আমাগো মত। তখন থেকেই আমাগো বাড়ির সবার উগো ওপর মায়া পড়ে গ্যেছে। ”
সন্ধ্যার পর বকের কলকাকলি আরো জমজমাট হয় জানিয়ে রেশমা বলে, “এখন তো কম, সুন্ধের (সন্ধ্যা) পর হাজার হাজার পাখি এখানে আসে। উগো কথার জন্যি আমরা নিজেগো মধ্যি কথাবার্তা শুনতে পাইনে। ”
জীবনের প্রয়োজনে রেশমার পরিবারের সবাইকে বাড়ির বাইরে যেতে হলেও কেউ না কেউ বাড়িতে থেকে যায় তারা। যাতে কোন শিকারীর কবলে না পড়ে পাখিগুলো।
রেশমার ১১ বছরের ভাই আনোয়ারুল; স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও যায় না সে।
রেশমা জানায়, ঝড়, শিলা বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকলে এদের সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বাড়তো।

গাছের ফাঁকে বসে থাকা সাদা বকগুলোকে দেখিয়ে রেশমা জানায় এরা ডিমে তা দিচ্ছে। অন্য সঙ্গী না ফেরা পর্যন্তÍ বসে থাকবে। সঙ্গী ফিরলে তাকে সেখানে বসিয়ে খাবারের সন্ধানে যাবে।
যেসব বকের বাসায় ছোট বাচ্চা আছে সেগুলো সন্ধ্যার আগে নিজের মুখে করে আনা খাবার তুলে দেয় বাচ্চার মুখে।
রেশমার কাছে এসব কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এমন সময়ই আমার ফোনে সংবাদ আসে কৈখালী সীমান্তের একজন লোক বাঘের আক্রমনে প্রাণ হারিয়েছে। তার লাশ গ্রামে আনা হচ্ছে।
সিদ্ধান্ত নিলাম যেতে হবে সেখানে। প্রাণচঞ্চল পাখিদের রেখে ছুটলাম কৈখালির উদ্দেশে।
বাংলাদেশ সময় ১০৪৭ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর