ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বাঘের মুখে কষে লাথি মারেন নজরুল

জেসমিন পাঁপড়ি. স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:৩৪, মে ১৪, ২০১২
বাঘের মুখে কষে লাথি মারেন নজরুল

শ্যামনগরের (সাতক্ষীরা) পাতাখালী থেকে: ‘বাঘটারে মেরেই ফ্যালে ওরা’! নিচু গলায় কথাটা বললেন নজরুল ইসলাম (৩৫)। চাপা গলায় উত্তেজনা।

বাঘের মুখ থেকে বেঁচে আসার গল্প শোনাচ্ছিলেন নজরুল।

``মেরে ফেলল কেন? বিস্ময়মাখা প্রশ্নে উত্তেজনা বাড়ে নজরুলের কণ্ঠে। বলেন, বাঘ আমার সঙ্গীকে কামড়ে মেরে ফেলল, আমাকে আধমরা করে ফেলল আর ওরা বাঘটারে ছেড়ে দ্যাবে?``--পাল্টা প্রশ্ন তার।

নজরুলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল খোলপেটুয়া নদীর তীরে বসে। শ্যামনগর থানার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী এটি।

সুন্দরবনের মানুষখেকো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখ থেকে বেঁচে আসা ভাগ্যবান জেলে নজরুল।

বছর দুয়েক আগের কথা। মাছ ধরতে ছয় সঙ্গী নিয়ে বনে যান নজরুল।

লক্ষ্মীখালী খাল দিয়ে যাওয়ার পথে রান্নার কাঠ সংগ্রহ করতে বনে ঢোকেন তারা। হঠাৎই বাঘের আক্রমণ। উত্তেজনা ঝড়ে পড়ে নজরুলের কণ্ঠে। তাদের সঙ্গী পীর আলীর পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ। মুহুর্তেই পিঠের উপর থাবা দিয়েই গলায় কামড় বসিয়ে দেয়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পীর আলী প্রাণ দেয় বাঘের হামলায়।

নজরুলসহ অন্যরা ততক্ষণে হাতের লাঠি ও কুঠার দিয়ে বাঘকে আঘাত করতে শুরু করে। আঘাতে ক্ষিপ্ত বাঘটি পীর আলীকে ছেড়ে এগিয়ে যায় নজরুলের দিকে। সাহসী নজরুল বাঘটির মুখ বরাবর কষে লাথি মারেন। এতে পড়ে যায় বাঘটি। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ে যান নজরুলও।

বললেন, “দ্রুত উঠে পড়ে যাওয়া বাঘটিকে আবারও লাথি মেরে কাছেই একটি গাছে ওঠার চেষ্টা করি। কিন্তু দেরী হয়ে যায়। ততক্ষণে বাঘটি উঠে পড়ে আর আমার পিছনে গাছে উঠতে শুরু করে। ” সমস্ত শক্তি দিয়ে নজরুল তখন দ্রুত উঠতে চেষ্টা করেন গাছের আরও উপরে। কিন্তু এরই মধ্যে বাঘটি দ্রুত উঠে নজরুলের বাম পায়ের গোড়ালীতে কামড় বসিয়ে দেয়। পা টেনে নিচেও নামিয়ে আনে অনেকটা। একের পর এক থাবা বসাতে থাকে নজরুলের শরীরে।

এদিকে নজরুলের সঙ্গীরা সজোরে পেটাতে থাকে বাঘটিকে, করতে থাকে উপর্যুপুরি কুঠারের আঘাত। এতে এক পর্যায়ে নজরুলকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বাঘটি। দ্রুত নেমে আসে নিচে। সঙ্গীকে হারানোর আক্রোশে চারদিক থেকে লাঠি আর কুঠার দিয়ে বাঘটিকে আঘাত করতে থাকে বাকি চারজন। কিছুক্ষণের মধ্যে পীর আলীর মৃতদেহের পাশেই নিথর হয়ে পড়ে যায় বাঘটি।

সঙ্গী হারানোর শোক, বাঘ মেরে ফেলার উত্তেজনায় দিশেহারা হয়ে পড়ে তাদের নজরুলের দলের সদস্যরা। মৃত পীর আলীর ও আহত নজরুলকে নৌকায় তুলে দ্রুত বাড়ির পথের দিকে রওনা হয় তারা। আহত নজরুলের পা ও শরীর থেকে তখন গলগল করে রক্ত ঝরছে।

নজরুল জানান, পথে দোবেকী ফরেস্ট অফিস পর্যন্ত পৌঁছলে সেখানকার বন কর্মকর্তারা নজরুলকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। (তবে বন বর্মকর্তাদের কাছে বাঘ মারার খবর গোপন করে তারা। ) এরপর তাদের সহায়তায় নজরুলকে নেওয়া হয় কয়রা হাসপাতালে। সেখানে যাওয়ার পথে পীর আলীর লাশ নামিয়ে দেয়া হয় তার বাড়ির ঘাটে।

কয়রা হাসপাতাল থেকে একটি ক্লিনিকে পাঠানো হলে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিয়ে ২৬ দিন পর বাড়ি ফেরেন নজরুল। বাড়িতে বসে কবিরাজের কাছে বাকি চিকিৎসা নিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে নজরুল বলেন, ``পীর আলীকে ছেড়ে যখন বাঘটা আমারে ধরলো, তখন মনে করিছি আমি আর বউ-ছাওয়ালের (স্ত্রী-সন্তানের) মুখ দেখতে পারবো না। একমাত্র আল্লার ইচ্ছায় আর আমার সঙ্গের মানুষগুলোর সাহসের জন্যি আমি ফিরে আসতি পারিছি। ``

তার কাছ থেকে জানা যায়, এ ঘটনার এক বছরের মাথায় আবারও বনে যান তিনি। কারণ জিজ্ঞাসা করলে নজরুল বলেন, ``বাঘের আঘাতের পর তেমন কোন কাজ করতে পারিনে। বন বাঁদাড় ভাল চেনা আছে বলে ভাইরা তাগো (তাদের) নৌকায় করে নিয়ে যায়। খুব বেশি বনে নামতে হয় না। ``

বনে গিয়ে সামান্য যা আয় হয় তা দিয়েই কোনো রকমে চলছে নজরুল ইসলামের পরিবার।

তবে তিনি জানান, তার স্ত্রী ও দু`সন্তান নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে। সেটাও সংসারের কাজে লাগে।

জীবনের ভয়াবহ দিনের গল্প বলে উঠে যাওয়ার আগে নজরুল বলেন, ``জানেন, আপা এখনো তো বনে যাই। কিন্তু একটু শব্দ শুনলিই চোমকে (চমকে) উঠি। মনে হয় এই বুঝি এ্যলো (আসলো)! কাজের চেয়ে মনোযোগ সেদিকেই বেশি থাকে আমার!``

বাংলাদেশ সময় ১১২০ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;

 জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 
Jewel_mazhar@yahoo.com
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।