তরুণরাই বদলে দেবে বাংলাদেশ। এই স্লোগান নিয়েই বর্তমান প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি এমনই সব স্বপ্নবাজ তরুণরা একসঙ্গে হয়েছিল ইয়ুথ লিডারশিপ সামিটে। সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে ৪৫০ জন তরুণদের অংশগ্রহণে গত ২৫ থেকে ২৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় এ সামিটের দ্বিতীয় আসর।
এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া আট তরুণনের সঙ্গে কথা বলেছেন জয়ন্ত সাহা। কথা বলেছেন তাদের স্বপ্ন নিয়ে। দেশকে নিয়ে তাদের ভাবনাগুলোও উঠে এসেছে আলাপচারিতায়।
নেতৃত্ব
আরমিন জামান খান , চতুর্থ বর্ষ , আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ( ইন্টার্ন)
সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহনের সুযোগ বাড়ছে। টেকসই উন্নয়নের তরুণরা উদ্ভাবনী প্রতিভায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারও দিকে না তাকিয়ে আত্মনির্ভরশীল তরুণরা নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত প্রতিটি ক্ষেত্রে। তরুণ প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা পদে পদে। কিন্তু তরুণরা সেসব অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলেছে।
দেশ ও সমাজকে নেতৃত্ব দিতে তরুণদের সবার আগে নিজেকে জানতে হবে। নিজ অবস্থানে থেকে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার উপায়গুলো জানতে হবে। সে লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসাবে আমি রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানাই, তরুণদের কথা বলার সুযোগ দিন। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিন। তরুণদের প্রতি আস্থা রাখুন।
বিশ্ব নাগরিকত্ব
নূরনবী হিরু (৩য় বর্ষ ,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীটা অনেক ছোট হয়ে এসেছে। সহজলভ্য প্রযুক্তির বদৌলতে আমরা আমাদের আইডিয়া সহজেই শেয়ার করতে পারছি পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে। পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে আমরা সমস্যা সমাধানের নানা পথও খুঁজে পেয়েছি।
আগ্রহী হয়ে উঠেছি অন্য দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক কৃষ্টি কালচার নিয়ে। নিজ চোখেই দেখে আসতে চাই ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা। কিন্তু সেই ভিসা জটিলতায় আটকে আছে আমাদের স্বপ্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অভিন্ন ভিসায় যাতায়াত করছে। সার্কেও অনুরুপ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য আলাদা ভিসা না করে কমিউনিটি নির্ভর ভিসা করতে পারলে অবাধ যাতায়াতের পথ সুগম হত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যেত দক্ষিণ এশিয়া।
প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন
মোহতারিমা সালসাবিল সাকি ( তৃতীয় বর্ষ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় )
প্রযুক্তি খাতে বাজেট নিতান্তই কম। ইন্টারনেট সুবিধাও অপ্রতুল। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। কিন্তু অগ্রগতি হচ্ছে কচ্ছপ গতিতে। সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে আমাদের তরুণরা এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের যা কিছু আছে, তাই নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ছে।
বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, রোবোটিকস, প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিযোগিতাগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি হয়ে উঠছে আমাদের তরুণরা। সম্প্রতি ভারতের ওয়েবসাইট হ্যাক নিয়ে শোরগোল তুলেছে আমাদের তরুণরাই। আমাদের সহযোগিতার করার জন্য দায় শুধু সরকারের, এমন ভাবাটা বিরাট ভুল। বেসরকারি উদ্যোগে আইটি সেক্টরে বিনিয়োগ খুব কম। নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি দেওয়া আইটি খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ চাই।
পাইরেসি ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে ঢেলে সাজাতে হবে। গ্রামে ইন্টারনেট ব্যবস্থা সুলভ হলে বেকারত্ব কমে আসবে । অনেক প্রকল্প টাকার অভাবে কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। প্রকল্পের বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নিজের একটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ফার্ম দেওয়ার ইচ্ছা আছে।
নারী নেতৃত্ব
ঈষিতা দাশ (৪র্থ বর্ষ ,মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়)
প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, সংসদ উপনেতার মত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীরা আসীন হয়েছেন। তাই বলে কী, দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়েছে?
নারীর পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে শিক্ষার হারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষিত পরিবারেও যখন গোয়ার্তুমি ও ধর্মীয় সংস্কারের ধোয়া তুলে অবদমিত করে রাখা হয় তখন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন জাগে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ডিগ্রীধারীরাই প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত।
সরকারি ও বেসরকারি জরিপে নারী নির্যাতনের চিত্রের বাইরেও কত অব্যক্ত গল্প আছে। শত প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে নারীরা তবুও এগিয়ে আসছে। সামাজিকতার নোংরা রীতি নীতিকে থোড়াই কেয়ার করছেন তারা। প্রান্তিক নারীরাও অধিকার আদায়ে সোচ্চার। মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখছে তারা ।
পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের তরুণরা নারীদের পাশে নিয়ে এগিয়ে চলছে। চাওয়া কেবল একটাই, সামাজিক পরিবর্তন। ধর্মীয় অপব্যাখা রোধে এগিয়ে আসতে হবে খোদ নাগরিকদের। মোল্লা- পুরুতের দল যারা প্রতিদিন ‘জাত গেল, জাত গেল’ বলে শোর তুলেন, তাদের প্রতিহত করতে হবে। ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা জানাতে হবে সবাইকে।
তরুণদেরই এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। নারী নেত্রীরা সভা- সেমিনারে বক্তৃতা না দিয়ে একজন নারী উদ্যোক্তার পাশে এসে দাঁড়ান। আপনার ঘরের গৃহকর্মীকে পড়াশোনা ও বিনোদনের সুযোগ করে দিন। একদিন ঠিক পাল্টে যাবে আমাদের সমাজ। নারী অগ্রগতিতে আমরাই হব রোল মডেল।
জলবায়ু পরিবর্তন ও নবায়নযোগ্য শক্তি
সুনেরা খান (চতুর্থ বর্ষ , অর্থনীতি ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে আমাদের সচেতনায় ঘাটতি রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। কার্বন নিঃসরনের জন্য দায়ী ধনী রাষ্ট্রগুলো নানা সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি দিলেও বেড়েই চলেছে পরিবেশ দূষনের হার। তাদের এই পদক্ষেপের শিকার তৃতীয় বিশ্ব।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলতে শুরু করেছে মেরু অঞ্চলের বরফ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে, বিলুপ্ত হবে একটি সভ্যতা। বিশ্বজুড়ে তরুণরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানদের এবার বাধ্য করছে জলবায়ু আইন বাস্তবায়নে। আমরা বাঙালি তরুণরাও পিছিয়ে নেই। আমরাও দেশ জুড়ে নানা কার্যক্রম গ্রহন করেছি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার খবর পৌঁছে দিচ্ছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব পড়ছে আমাদের পর্যটন শিল্পে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিলুপ্ত হওয়াতে হারিয়ে গেছে বিচিত্র প্রানী জগৎ। তরুণ শিক্ষার্থীরা এবার জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতেই শোর তুলেছেন এ সম্মেলনে। তেল, কয়লা না পুড়িয়ে এবার নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যাপারটিও ভাবতে হবে বাংলাদেশের। চাহিদা মিটাতে অক্ষম বিদ্যুৎ খাতে এবার সোলার এনার্জির কথা ভাবতে হবে। সৌর প্যানেলের খরচ কমিয়ে এনে এর ব্যবহার বাড়াতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া
ফাবিনা ফারজিন (৪র্থ সেমিস্টার, বিবিএ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়)
ফেসবুক, টুইটার তো এখন জীবনের অংশই হয়ে গেছে। এদের সাহায্যে পৃথিবী ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ঘরে বসেই জেনে নেওয়া যায় তাবৎ দুনিয়ার খবর। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটেই তরুণরা নিজেদের মতামত জানাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তারা সিদ্ধান্তও নিচ্ছে।
বিশ্বের এ প্রান্তের একজন বন্ধু অন্য প্রান্তে থাকা বন্ধুর সঙ্গে কত সহজেই নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিক অবস্থান নিয়ে আইডিয়া শেয়ার করতে পারছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণরা সামাজিক কার্যক্রমেও সাড়া ফেলেছে। প্রচার মাধ্যমগুলোতেও তরুণ কর্মীরা নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে চলমান খবর জানিয়ে দিচ্ছে মূহুর্তেই।
স্যোশাল মিডিয়ার সরকারি নজরদারি জুলুমবাজি ছাড়া আর কিছু না বলেই আমি মনে করি। নিজ গ্রামে নারীদের জন্য একটি স্কুল খুলেছি। সে স্কুলের ব্যাপারে বিস্তারিত ফেসবুকেই জানিয়ে দিচ্ছি বন্ধুদের।
সুশাসন
অমিত বড়ুয়া ( ৪র্থ বর্ষ, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং , রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)
সমাজের প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতি। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি এমনভাবেই মিশে গেছে, রাতারাতি একে নির্মূল করা সম্ভব নয়। ভূত তাড়ানোর সরষেতেই ভূত! দুর্নীতি তাড়াবে কে? দুর্নীতি কমাতে হলে নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমজনতাকে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্তদের হাতে রাষ্ট্রের ভার ন্যস্ত আর নয়।
শিক্ষিত, সৎ, দেশপ্রেমিক নাগরিকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহনের সুযোগ দিতে হবে। সুস্থ রাজনীতির চর্চা বাড়াতে হবে। তবেই দেশে সুশাসন নিশ্চিত হবে।
শিক্ষা ও ক্যারিয়ার
অন্তরা ইসলাম , দ্বিতীয় বর্ষ, আইবিএ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যবসা প্রশাসনের ছাত্রী হলেও সামাজিক দায়বোধ থেকে আমি একটি এনজিওর সঙ্গে দুস্থ শিশু ও নারীদের স্কুলে পড়াই। ক্লাস শেষ করেই আমি গ্রামে চলে যাই। আজকের শিশুরাই আগামীর কর্ণধার। তাদের মধ্যে ভালো কিছুর বীজ বুনে দিতে পারলে সেটা সুফলই বয়ে আনবে। শুধু পাঠ্যপুস্তকের গৎবাধা সিলেবাস মানেই শিক্ষা , এমনটা ভাবতে আমি নারাজ।
প্রতি মূহুর্তে চারপাশে ঘটে চলা জীবনচিত্র শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলার নামই শিক্ষা। সুশিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক স্বাবলম্বী হতে পারলে পাল্টে যাবে গোটা সমাজের চিত্র। শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ থাকলেও শিক্ষা কেবল টাকাওয়ালা মানুষের হাতের মোয়াই রয়ে গেছে। উচ্চ শিক্ষার দ্বার গরীবের জন্য অবরুদ্ধ। সরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার অধিকার কেবল বিত্তশালীদের। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে শিক্ষা খাতে কোন অগ্রগতি আসবে না।
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর এ+ মানেই শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, এমনটা বোকারাই ভাবেন। সিলেবাসে কর্মমুখী কোর্স অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশেষজ্ঞ মহল অভিমত জানালেও সংশ্লিষ্টরা তা কানেই তুলেনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম দূর করে অবিলম্বে ঢেলে সাজাতে হবে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের তরুণদের এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘুম ভাঙ্গাতে হবে আমাদেরই।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, ইয়ুথ এনগেজমেন্ট এডিটর