ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

খোলাপাড়ার সবুজ বিপ্লবীরা

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:২৯, মে ১৬, ২০১২
খোলাপাড়ার সবুজ বিপ্লবীরা

কোনাবাড়ী (গাজীপুর) থেকে ফিরে: ‘১৫/২০ বছর আগে এই গেরামে বেবাক জমি পতিত পইড়া থাকতো। পুলাপাইনে খেলার মাঠ বানাইয়া খেলতো।

কিছু জমিত আউস ধান বুনতাম। এলাকায় অভাব লাইগ্যাই থাকতো। আর এ্যাহন সবজি কইরা অনেক ভালা চলবার পারি। ’

কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুর সদর উপজেলার কোনাবাড়ী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম খোলাপাড়ার সবজি চাষী হাজী আব্বাস আলী (৬০)। তিনি জানান, ধান চাষের চেয়ে সবজি চাষ দ্বিগুণ লাভজনক, ফসল তোলা যায় অনেক কম সময়েই, পরিশ্রমও কম।

খোলাপাড়া গ্রামের আনাচে কানাচে যে খানেই চোখ যাবে সবখানেই চোখে পড়বে ধুন্ধল, চিচিঙ্গা, পেঁপে, শসা, লালশাক, মিষ্টিলাউ, বেগুনসহ নানা সবজির ক্ষেত। সারিবদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন সবজি ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য দৃষ্টি জুড়িয়ে দেবে যে কারো।  

আব্বাসের মতই উচ্ছাস আর স‍াফল্যগাঁথা ওই গ্রামের প্রায় সব কৃষকদের মুখে মুখে। একসময় মাটির কুঁড়ে ঘরে দিনযাপন করলেও বর্তমানে পুরোপুরি পাল্টে গেছে এ গ্রামের দৃশ্যপট।

খোলাপাড়ার বিভিন্ন ‍অংশ ঘুরে সর্বত্রই দেখা মিলবে সুদৃশ্য পাকা বাড়িঘর। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, কৃষি সাফল্যই এতসব সম্বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ।

বিপ্লবের শুরু যে ভাবে: লাল মাটির উঁচুনিচু ভূমিতে ফসল ফলাতে খুব বেশি উদ্যোগী ছিলেন না এই অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষক। তাদের ধারণা ছিল কেবল এখানকার নীচু বাইদ জমিগুলোই ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগি। কিন্তু ৮/১০ বছর আগে স্থানীয় কয়েক জন কৃষক পরীক্ষামূলক ভাবেই সবজি আবাদ শুরু করে পাল্টে দেন সেই ধারণা।

শুরুতে কয়েকজন সবজি চাষির সাফল্য অনুপ্রাণিত করে অন্য চাষিদেরকেও। ক্রমান্নয়ে খোলাপাড়ার সব কৃষকই ঝুঁকে পড়েন সবজি চাষে, এ যেন এক প্রতিযোগিতার মতই। কার আগে কে সবজি লাগাবে। কারণ আগে ফলন পেলে দামও পাওয়া যাবে বেশি।  
 
গাজীপুর সদর উপজেলার প্রতাপপুর কৃষি ব্লকের অধীন সাতটি গ্রাম,- কৃষ্ণপুর, জয়েরটেক, আহাকি, রাজাবাড়ি, কাতলাখালি, প্রতাপপুর ও খোলাপাড়া। এই সাঁতটি কৃষি প্রধান গ্রামের মধ্যে খোলাপাড়া, জয়েরটেক ও প্রতাপপুর সবজি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধি । স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, এই তিন গ্রামে দেড়শ’ হেক্টর কৃষি আবাদি জমির মধ্যে সবজি চাষ হচ্ছে ৪০ হেক্টর।

এখানকার সবজি চাষিদের তথ্য অনুযায়ি, বর্তমানে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩-৪ লাখ টাকার সবজি কেনাবেচা হয় এই গ্রামগুলোতে।

বিষমুক্ত সবজি: এই অঞ্চলে উৎপাদিত সবজির বেশির ভাগ কেনাবেচা হয় স্থানীয় কোনাবাড়ি বাজারে। কেউ আবার ক্ষেত থেকেই কিনে নেন পছন্দের সবজি। তবে দেশের শীর্ষ সবজি ব্যবসায়িদের কাছে বিশেষ কদর রয়েছে এখানকার সবজির। কারণ এখানকার বেশির ভাগ সবজিই উৎপাদিত হয় বিষমুক্ত উপায়ে। সবজি ব্যবসায়িদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠান খোলাপাড়া, প্রতাপপুর ও জয়েরটেকের সবজি।

বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের বিষয়ে জানতে কথা হয় স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা খ ম শফিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, আমি কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে ৭ বছর পূর্বে এই ব্লকের দায়িত্ব পাই। শুরু থেকেই উদ্ভাবিত নতুন কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। এর মধ্যে জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা ও জৈব কম্পোস্টের বিষয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করতে থাকি।

শফিউদ্দিন বলেন, প্রথমে কৃষকরা এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশি অভ্যস্ত না হলেও ধীরে ধীরে তা গ্রহণ করতে শুরু করে। বিশেষ করে ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনে সেক্সফোরোমন প্রযুক্তি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে কৃষকরা এই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে।

কৃষি বিভাগ থেকেই বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়ে থাকে এই সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ। খোলাপাড়া গ্রামের অনেক সবজি ক্ষেত ঘুরেই দেখা মেলে এই প্রযুক্তি।     

বদলে যাওয়া এক আব্বাসের গল্প: গাজীপুর সদর উপজেলার কাউলতিয়া গ্রামের যুবক  মোঃ আব্বাস আলী। এপেক্স কারখানায় কিছু দিন চাকুরি করে খোলাপাড়া গ্রামে নার্গিস আক্তারকে বিয়ে করে সে। পড়াশুনাও বেশিদূর করা হয়নি, স্কুল অবধিই ইতি টানতে হয় সংসারের দারিদ্রের কাছে হার মেনে।

বিয়ের পর কিছু দিন আব্বাস শশুড়বাড়িতে বসবাস করতে থাকে। ৬-৭ বছর আগে খোলাপাড়া গ্রামের অন্য সবজি চাষিদের দেখাদেখি সবজি চাষের শখ পেয়ে বসে আব্বাসের। কিন্তু জমি পাবে কোথায়, চিন্তায় পড়ে যায় আব্বাস। অবশেষে পতিত পড়ে থাকা ৫ বিঘা জমি পত্তন নিয়ে শুরু হয় তার সবজি চাষ। প্রথমে ধুন্দল (স্থানীয় নাম ধুমরা) চাষ করে আব্বাস। শুরুতেই ব্যাপক ফলন হয়। এরপর আব্বাসের এক রকম নেশা পেয়ে বসে সবজি চাষের।

ধীরে ধীরে এই চাষ আরো সম্প্রসারিত করতে থাকে সে। বর্তমানে ৪ বিঘা জমিতে পেঁপে, আড়াই বিঘা জমিতে ধুন্দল ও ১ বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করছে আব্বাস। এক সময় অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও এখন তার ক্ষেতেই ৫/১০ জন সব সময় কাজ করে। বছরে কয়েক লাখ টাকার সবজি বিক্রি করে সে।

সবজি বিক্রির টাকায় খোলাপাড়া গ্রামের নিজের নামে জমি কিনে পাকা ঘরও নির্মাণ করছে আব্বাস। শশুড়বাড়ির লোকজন এক সময় আব্বাসকে খাটো করে দেখলেও এখন বেশ সম্মানের সঙ্গেই দেখেন তাকে।

সফল চাষি আব্বাস বাংলানিউজকে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ‘একটি পাওয়ার টিলার কিনবার পারলে ভালা অইতো। এছাড়া ২০-৩০ বিঘা জমির একটি বড় প্রজেক্ট করবার  চাই। যাতে নিজেই দেশের বাইরে সবজি পাডাইবার পারি। ’

বাংলাদেশ সময়ঃ ০২১৯ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১২
এআই / সম্পাদনা: বেনু সূত্রধর, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।