ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সীমার স্বপ্ন বাঁচাতে একটা স্কুল চাই

সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৩২, মে ২২, ২০১২
সীমার স্বপ্ন বাঁচাতে একটা স্কুল চাই

সীমার সঙ্গে  এখনও আমার পরিচয় হয়নি। তবু গত কয়েকটা দিনে আমি, আমার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে সীমা খুব পরিচিত।

প্রতিদিন সবাই উৎকন্ঠায় থাকে।   অপেক্ষা করে। সীমার জন্য একটা স্কুল পাওয়া গেল কি? এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা। পাওয়া যাবে তো, তার উৎকন্ঠা। কিন্তু ১১ দিনেও এর একটির জবাবও মেলেনি।

নুসরাত, কলি, পাপিয়া, ঝিলিক, রিমন, তুষার, নাদিম, সুমি, জাকিরসহ ২১জন মিলে অর্ধশত স্কুল খুঁজে ফেলেছি। লাখ টাকা গুরু দক্ষিণা নেওয়া স্কুল থেকে শুরু করে মাগানার প্রাইমারি স্কুল যেখানেই হোক সীমার জন্য একটি আসন। ‘ডানে বায়ে ঘুরে বেড়াই, মেলান যদি প্রভু। ’ কিন্তু ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজার কোথাও সীমার জন্য স্কুল নেই। অন্ধ, মূক, বধির, সুস্থ, সাদা-কালো, মেধাবি-মেধাহীন, মনোযোগী-অমনোযোগী, বিত্তবান-বিত্তহীন সব শিশুর জন্য স্কুল আছে এই শহরে। আছে নাচের, গানের, আঁকার আর কত রকম স্কুল। শুধু একটা স্কুল নেই সীমার জন্য।

কত স্কুলে যে আমার গেলাম! যখন বলি একটা বাচ্চা ভর্তি করব। অনেকেই রাজি হয়। কিন্তু সীমার ছবিটা দেখে পরক্ষণেই বলে না ভর্তি সম্ভব নয়। কেউ কেউ বিনয়ের সঙ্গে বলে “আসলে হয়েছে কী! বছরের মাঝামাঝি আমরা ভর্তি করি না। ” আবার কেউ সহানুভ’তি দেখিয়ে বলে “গ্রামের মেয়ে! বুঝেনই তো এখানে প্রতিযোগিতায় পারবে না। ”

যাদের বৈষয়িক বুদ্ধি ভালো, তারা বলেন “আরে ভাই! এত টাকা খরচ করে পড়িয়ে লাভ কি বলুন তো?” আরেকজন আরো এককাঠি সরেস। যে কিনা স্কুলের মালিক। তার ভাণ্ডারে আছে ডজনখানিক দেশ দেখার অভিজ্ঞতা। তিনি পরামর্শ দিলেন, সীমার জন্য একটা স্কুল খুলে ফেলবার। আশ্বাস দিতেও কার্পণ্য করেননি। বলেছেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন। স্কুল খোলার পরই আমরা বুঝব কেন সীমাকে ভর্তি করা হয়নি।   সীমার জন্য স্কুল না পেলেও বিনামুল্যে এমন হাজারও উপদেশ পাচ্ছি।

এখন সীমার কথা বলি। স্কুলে ক্লাশ টুতে পড়ে। বয়স মাত্র নয়। চোখ বন্ধ করলেও, ভেসে ওঠে লাল টুকেটুকে জামা পড়া একটি দুরন্ত শিশুর মুখচ্ছবি। বুদ্ধিদীপ্ত, দুষ্টুমিভরা এক জোড়া চোখ। কিন্তু আমাদের সীমা এমন নয়। হয়ত এমনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওর বয়স যখন নয়, তখন তার পাষণ্ড বাবা ও চাচা এসিড ঢেলে সীমা ও তার মায়ের মুখ জ্বলসে দেয়। ওর সুশ্রী চেহারার লাবণ্যটুকু কেড়ে নিয়েছে এসিড। এরপর পদ্মায় মেঘনায় অনেক জল গড়িয়েছে। মাতৃক্রোড় হারিয়ে, সীমা এখন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুলের আবাসিক ছাত্রী।

সীমার মা মীরা। সংসার হারিয়েছেন অনেককাল আগেই। নিজেও এসিডদগ্ধ। সব মেনে নিয়েছেন। শুধু এখন একটিই চাওয়া। নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চান। এই আকুতিই তার কণ্ঠে সারাক্ষণ। বলেন, “ইদানিং ঘুমের মাঝে মেয়েটাকে বেশি বেশি স্বপ্নে দেখি। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সারারাত আর ঘুম আসে না। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে কেমন লাগে। মনে হয় মেয়েটার কাছে ছুটে যাই রাতেই। প্রায়ই ভাবি মেয়েটাকে ঢাকায় নিয়ে আসব। কিন্তু এই শহরে তো কোনো স্কুলে সীমারে স্কুলে ভর্তি করব না”। তাই কোনো উপায় না পেয়ে একটা প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করে রেখেছি। আমার মেয়েটা ভাই প্রতিবন্ধী না। তারপরও কোন উপায় নেই।

আমার প্রবাসী বন্ধু এটম রহমান নিজের মাকে দেশে ফেলে হাজার মাইল দূরে থাকেন। তাই সীমার ও তার মায়ের কষ্টটা খুব করে বুঝেন তিনি। এই কষ্টের অবসান করতে চান। তাই নিজেই উদ্যোগ নিয়ে স্কুল খুঁজে বের করে সীমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে চান। সেই অনুযায়ী চেষ্টাও করছেন। সীমার মায়ের জন্য ঢাকায়  বাসস্থান ও কর্মসংস্থান দুই-ই খুব কঠিন নয়। কিন্তু সব উদ্যোগ আটকে গেছে, কেন না সীমার জন্য দুই কোটি মানুষের রাজধানীর কোনো স্কুলেই একটি আসন নেই। অনেক চেষ্টা করেও পাওয়া যায় না। প্রতিবন্ধী স্কুল হয়ত সীমাকে ভর্তি করাবে। কিন্তু একটাই প্রশ্ন- একজন স্বাভাবিক বুদ্ধির শিশুকে কেন ভর্তি হতে হবে বিশেষ শিশুদের স্কুলে?

সবাই মিলে রোজই স্কুল খুঁজি। ভাবি হয়ত পরের স্কুলেই একটা আসন হয়ে যাবে সীমার জন্য। অস্ট্রেলিয়ায় ফোন করে, এটম ভাইকে বলতে পারব “ভাই...! স্কুলটা আমি পেয়ে গেছি সত্যি। এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না। ” আমি জানি এটম ভাইও এই কথা শুনতে অধীর অপেক্ষায় আছেন। তার বিশ্বাস আমরা একটা স্কুল খুঁজে পাবই। এই বিশ্বাস নিয়ে আমাদেরও  সকাল শুরু হয়। আমরা স্কুল খুঁজি। আজও খুঁজব।

এই শহরে সভা সেমিনারে আমিও চিৎকার করেছি বহুবার, বলেছি অধিকার! অধিকার! শতবার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭এ একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দানের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৯ (১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।

আমার একবন্ধু (বড় আপা) ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছেন দুই বছর ধরে। গত মাসে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্কুল খোঁজা, অফিস, আড্ডা দরকারি ও অদরকারি শত কাজের মাঝেও দিনে অন্তত একবার তাকে দেখতে যেতে হয়। মানুষটা মৃত্যুর জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন। আপার মোবাইল ফোন থেকে কল আসলে আমি রিসিভ করি না। প্রায় ভয় হয়। আপাও ঘটনাটা বুঝে ফেলেছেন। তাই উনি আমাকে এখন ফোন না দিয়ে এসএমএস করেন। শোভন স্কুল কি পেলি? গত এগারোদিনে ১৮টি এসএমএস দিলেন। একই শব্দ, একই বাক্য কাট অ্যান্ড পেস্ট । শোভন স্কুল কি পেলি? কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব যাদের কাছে আছে, তারা আমাকে দেয় না। তাই আমিও আপাকে রিপ্লাই দিতে পারি না।

এদেশের সংবিধান, আইনে সুস্পষ্ট করে শত শত বার লিখা আছে সীমার অধিকারের কথা। কিন্তু আজ কোনো আইন, অধিকারই সীমার জন্য স্কুলের সন্ধান দিতে পারছে না। তারপরও আমাদের স্কুল খোঁজার দলটা ক্রমেই বড় হচ্ছে।
এক সময় হাজার ব্যস্ততার মাঝেও বিদেশ থেকেই নানাভাবে এটম রহমান একাই সীমার জন্য যে স্কুলটার খোঁজে বেড়িয়েছিলেন। আজ সেই দলটি অনেক বড়। প্রতিদিনই একজন না একজন যুক্ত হয়। পরশু রাতে এসে যুক্ত হয়েছেন ইটিভির সাঈদ মুন্না, সমকালের আমার বন্ধু রাজিব আহাম্মদ। দলটা এখন প্রায় ত্রিশ ছুঁয়েছে। আমরা সীমার স্বপ্নপূরণে একটা স্কুল খুঁজে বের করার স্বপ্ন দেখি। এই নগরে একটা স্কুল খুঁজে পেতেই হবে।

আমরা বিশ্বাস করি ইট-পাথরের এই শহরের সবগুলো মানুষের হৃদয় এখনও পাথর হয়ে যায়নি। এই হাজারো সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমরা একটা স্কুল পাব। কারো দয়া কিংবা করুনায় নয়। সীমা তার সাংবিধানিক অধিকার, মানবিক অধিকার বলে মাথা উচুঁ করে স্কুলে যাবে।   সীমার পরশে আমাদের সমাজ ‘প্রতিবন্ধী মানসিকতা’ থেকে মুক্তি পাবে।

বি:দ্র: সীমা এবং মীরাকে (সীমার মা) এসিড নিক্ষেপের অপরাধে নিন্ম আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মানুষগুলো উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে ভাল আছে।

shovan1209@yahoo.com

বাংলাদেশ সময় : ১৩৪৭ ঘণ্টা, ২২ মে, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।