ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

উপকূলীয় এলাকার কন্যাশিশু

তেরতেই থেমে যায় যাদের কৈশোর

জেসমিন পাঁপড়ি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪৮, মে ২২, ২০১২
তেরতেই থেমে যায় যাদের কৈশোর

সাতক্ষীরা থেকে ফিরে : চলতে-ফিরতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের হাতে মাছ ধরা জাল ওঠে। নদীর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে চলতে চলতে কয়েক বছরেই ওরা হয়ে ওঠে বিবাহযোগ্য ‘সেয়ানা’ মেয়ে।



এই মেয়েদের বাস সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় গ্রামগুলোতে।

বয়স বার-তের পার না হতেই এদের কৈশোর শেষ হয়ে যায়। এরা হয় অন্যের ঘরের বউ। আটকে পড়ে সংসার নামক এক অদৃশ্য বেড়াজালে। অল্পবয়সে মা হওয়াসহ নানা রকম রোগে ভুগে তারুণ্যের আগেই বৃদ্ধ হয়ে যায় ওরা। বাল্যবিবাহের পরিণতিতে শুধু শিশু, অল্পবয়সী নারী বা তার পরিবারই আক্রান্ত হয় না, অপুষ্টি ও দুর্বল ভবিষ্যত প্রজন্মের উত্তরাধিকারীও হয় এসব এলাকা।

শ্যামনগর উপজেলার আইলা বিধ্বস্ত বিভিন্ন উপকূলীয় গ্রাম ঘুরে দেখা, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয় এসব এলাকার মেয়েদের। এক্ষেত্রে বিয়ের সরকারি বয়সসীমা তো মানাই হয় না, বরং অভাবের দোহাই দিয়ে প্রসাশনের সামনেই দিনের পর দিন কন্যাশিশুদের ঠেলে দেওয়া হয় বাল্যবিবাহ নামক পরিস্থিতির দিকে। এজন্য বাল্যবিবাহের পাশাপাশি অসম বিয়ের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। চলে যৌতুকের দেওয়া-নেওয়াও।

সরেজমিনে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যেক ঘরেই আছে কিশোরী বধূ অথবা একাধিক সন্তানের কিশোরী মা।

গাবুরা গ্রামের রহিমা জানায়, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের রফিকুলের সঙ্গে। রফিকুলের বয়স তখন ১৯ বছর।

রহিমার মা আলেয়া বলেন, ‘বিয়ে না দিয়ে কি করবো, সবাই যে বয়সে মেয়ের বে (বিয়ে) দেয় আমরাও সে বয়সে বে দিছি। অন্যায় হবে ক্যা?’

রহিমা জানায়, তার বিয়েতে একটি নৌকা ও মাছ ধরার একসেট জাল যৌতুক হিসেবে দিতে হয় বরপক্ষকে। সে জাল দিয়েই এখন নদীতে মাছ ধরতে যায় রফিকুল।

একই গ্রামের ওয়াজেদ বলেন, ‘আমাগো গ্রামে প্রাইমারি স্কুল আছে, কিন্তু হাইস্কুল বেশ দূরে। অত দূরে মেয়েগো পাঠানো ঝামেলা। তাই কোনো রকমে প্রাইমারি পাস দিতি পারলিই বে’র ব্যবস্থা করতি হয়। ’

হরিনগর এলাকার স্কুল শিক্ষিকা সেলিনা আক্তার জানান, এসব এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে কয়টা মেয়ে যায় তার ৫০ শতাংশও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যায় না। আর মাধ্যমিক পর্যন্ত যারা কোনো রকমে পৌঁছায় তাদের মধ্যকার কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যায় কিনা সন্দেহ।

পাতাখালি গ্রামের মৌসুমী বলে, ‘খুব ইচ্ছা ছিল, এসএসসিতে এ প্লাস পাবো। কিন্তু ক্লাস নাইনে উঠতেই আব্বা বিয়ে দিয়ে দিলেন। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা রাজি না হওয়ায় আর স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ’

জানা যায়, অষ্টম শ্রেণীতে পড়া মৌসুমীর বোন মামুনির জন্যও পাত্র খোঁজা হচ্ছে। অবস্থা সম্পন্ন ঘর পেলে শিগগিরই বিয়ে হবে তারও।

এসব বিয়ের ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধনের পরোয়াও করা হয় না।

বিয়ের ব্যাপারে সরকার নির্ধারিত বয়সসীমার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে গাবুরা ইউনিয়নের ৯ নম্বর সোরা গ্রামের বাসিন্দা আবু মুসা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। এত বয়স পর্যন্ত মেয়ে ঘরে রাখলি বিয়ের সময় বেশি করে জিনিসপত্র দেওয়া লাগে। সেসব কি করে জোগাড় করবো?’

খোলপেটুয়া নদীতে জাল টানারত রওফুন বেগম বলেন, ‘আমাগো মত গরিবের সংসারে হাত বাড়লি আয়ও বাড়ে। আগে একা জাল টানতাম। এখন ছেলের বউ আর আমি টানি। অল্প হোলিও আয় বেড়েছে। তাছাড়া বউয়ের বাপ খুশি হয়ে আমার ছাওয়ালকে জাল-দড়ি দিছে। নিজের নৌকা নিয়ে তা দিয়েই সাগরে মাছ ধরে সে। ’

পেশাগত মিল থাকায় এসব গ্রামের বিয়ের সম্পর্কগুলোও গড়ে ওঠে পাশাপাশি গ্রামে। দূরের গ্রাম বা উপজেলা শহরেও এসব গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয় খুব কম।

অসংখ্য এনজিওকে এসব এলাকায় নানামুখী কাজ করতে দেখা গেলেও বাল্যবিবাহ রোধে এগিয়ে আসতে কাউকেই দেখা যায়নি বলে জানান এলাকাবাসী।

তবে গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল হক বলেন, এসব এলাকায় বাল্যবিবাহের ঘটনা আছে। অনেক ক্ষেত্রে বাধা দিতে গিয়েও গরিব পিতা-মাতার দিকে তাকিয়ে চুপ থাকতে হয়। তবে এর মাত্রা কমেছে বলে দাবি করে তিনি আরো বলেন, স্কুলগামী কন্যাশিশুদের সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে বাল্যবিবাহের সংখ্যাও।

বাংলাদেশ সময় : ১৬৩১ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১২
জেপি/ সম্পাদনা : অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।