ছোটবেলা থেকেই বই পড়ুয়া অ্যাডোরা সভিতাক। তিন বছর বয়স থেকেই বাবা-মা’র কোলে কল্পকাহিনী শুনতে পছন্দ করতো সভিতাক।
মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই সভিতাক জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন গণসামাজিক কাজে। এর মধ্যে শিক্ষার প্রচার ও প্রসার অন্যতম। বর্তমানে সে বড় ও ছোটদের প্রতি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। বড়রাও ছোটদের চেয়ে কম নয়; এমনই প্রসঙ্গ বারবার টেনে আনার চেষ্টা করছেন অ্যাডোরা সাভিতাক।
অ্যাডোরা সভিতাক ২০১০ সালে টেডএক্স সম্মেলনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সে বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অংশ স্বপ্নযাত্রার পাঠকদের জন্য তুলে দেওয়া হলো।
শুরুতেই আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই, আপনাকে শেষ কবে ‘ছেলেমানুষ’ বলে ডাকা হয়েছিল? আমার মতো ছোটদের প্রায়ই ‘ছেলেমানুষ’ বলে ডাকা হয়। যখনই আমরা কোনো অযৌক্তিক আবদার করি বা কোনো দায়িত্বহীন আচরণ করি, তখনই আমাদের আচরণকে শিশুসুলভ বলা হয়। আমি এ বিষয়ে খুবই বিরক্ত।
একবার একটু ভাবুন। সাম্রাজ্যবাদ এবং যুদ্ধের জন্য কে দায়ী? জর্জ ডব্লিউ বুশ? নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন। দায়ী কে? বড়রা।
তাহলে, বাচ্চারা কি করেছে? অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক তার ডায়রি দিয়ে হাজারো মানুষের মন আলোড়িত করেছে। রুবি ব্রিজেস যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত ব্যবধান বন্ধ করতে সাহায্য করেছে। সম্প্রতি চার্লি সিম্পসন তার ছোট মোটরবাইকে চড়ে হাইতির জন্য ১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড জোগাড় করতে সাহায্য করেছে।
তো, এসব উদাহরণ থেকে কি প্রমাণ হয়, বয়সের সঙ্গে এ সবের কোনোই সম্পর্ক নেই। ‘ছেলেমানুষ’ শব্দটির সঙ্গে জড়িত বৈশিষ্টগুলো বড়দের মধ্যে সচরাচর দেখা যায়। আমাদের উচিৎ এ বয়সে বিভেদ শব্দটা উচ্ছেদ করা উচিত।
কিন্তু আবার, কে বলতে পারে এ বিশেষ ধরনের যুক্তিহীন চিন্তা-ভাবনাগুলোর আসলেই কোনো দরকার নেই? হয়ত আপনার আগে কোনো বিশাল পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নিজেকে থামিয়েছেন, এই ভেবেঃ এটা অসম্ভব বা এটা অনেক দামী বা এটা থেকে আমার কোনো লাভ হবে না।
শিশুদের মধ্যে অফুরন্ত স্বপ্ন থাকে। তাদের আশাবাদী ভাবনা থাকতে পারে। যেমন আমার ইচ্ছা কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না বা এমন এক স্বর্গরাজ্য যেখানে সব কিছু অবারিত। আপনাদের মাঝে কজন এখনও এ রকম স্বপ্ন দেখেন? কজন এ সম্ভাবনাগুলোতে বিশ্বাস করেন?
মাঝেমাঝে নিখুঁত স্বর্গরাষ্ট্র তৈরির আদর্শগুলো ব্যর্থতার ইতিহাস হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ আপনি জানেন যদি সবকিছু বিনা পয়সায় পাওয়া যেত, তাহলে খাবার-দাবার শেষ হয়ে আসত। যা একটি জটিলতা তৈরি করত। অন্যদিকে আমরা শিশুরা এখনও নিখুঁত জিনিসের স্বপ্ন দেখি। এটা একটি ভাল ব্যাপার, কারণ কোনো কিছুকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হলে প্রথমে তার স্বপ্ন দেখতে হবে।
শিশুরা বড়দের কাছে থেকে এমনিতেই অনেক কিছু শেখে। আমি মনে করি বড়দের উচিৎ শিশুদের কাছ থেকে শেখা শুরু করা। আমি আমার বেশিরভাগ বক্তৃতা দেই শিক্ষা সভা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সামনে। আমার এ তুলনাটা পছন্দ। খালি একজন শিক্ষক ক্লাসের সামনে থেকে ছাত্রদের বলছেন এটা করো, ওটা করো, এ রকম হওয়া উচিৎ নয়। ছাত্রদেরও উচিৎ তাদের শিক্ষকদের শেখানো। প্রাপ্তবয়স্কদের এবং শিশুদের মাঝে শিক্ষা দান করা পারস্পারিক হওয়া উচিৎ। দুর্ভাগ্য বাস্তব পরিস্থিতি একটু ভিন্ন এবং এর অনেকটাই বিশ্বাস, বা তার অনুপস্থিতির কারণে।
বড়রা বাচ্চাদের প্রতি বেশিরভাগ সময় একটি অবরোধসুলভ মনোভাব পোষণ করে। এটি প্রতিটি স্কুলের নীতিমালার মতো ‘এটা করো না’, ‘ওটা করো না’ থেকে স্কুলে ইন্টারনেট ব্যবহারে ওপর বিধিনিষেধও চাপিয়ে দেয়। ইতিহাস দেখায় শাসনব্যবস্থা তখনই অত্যাচারি হয়ে ওঠে যখন তাদের কর্তৃত্ব সংশয়পূর্ণ হয়ে ওঠে।
এখন তো বড়রা ছোটদের শুধু বাধা দেয় না; প্রায়ই তারা ছোটদের কর্মক্ষমতাকে হেয় করে। আমরা কাজ করতে পছন্দ করি। কিন্তু যখন আমাদের কাছ থেকে কম আশা করা হয়, তখন বিশ্বাস করুন আমাদের পুরো হতাশায় পড়ে যাই। আমার নিজের বাবা-মা আমার প্রতি আর যাই হোক কম আশা পোষণ করেনি। তারা আমাদের ডাক্তার বা উকিল বা ওইরকম কিছু হতে বলেনি। কিন্তু আমার বাবা আমাদেরকে এরিস্টটল এবং খারাপের বিরুদ্ধে অগ্রগামী যোদ্ধাদের কাহিনী পড়ে শুনিয়েছেন।
চার বছর বয়স থেকে আমি লেখতে ভালবাসি। যখন আমার বয়স ছয় মা আমাকে ল্যাপটপ কিনে দেন। ধন্যবাদ বিল গেটস এবং মাকে। সেই ছোট ল্যাপটপে আমি ৩০০-র বেশি ছোটগল্প লিখেছি। আমার ইচ্ছা ছিল ওগুলো প্রকাশিত হোক।
একটা শিশু প্রকাশিত হতে চায়। এ সাহসের দিকে ব্যঙ্গ না করে বড় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে না বলে, বাবা-মা আমাকে সমর্থন করেছিলেন। অনেক প্রকাশকরা এতটা উৎসাহিত ছিল না। এক শিশু-সাহিত্য প্রকাশক ব্যঙ্গ করে বলেছিল, আমরা শিশুদের সঙ্গে কাজ করি না।
শিশু-সাহিত্যের প্রকাশক শিশুদের সাথে কাজ করে না? আমি ঠিক জানি না। কিন্তু এখানে বড় মক্কেলকে বিদায় করা হচ্ছে। একজন প্রকাশক নাম হচ্ছে অ্যাকশন প্রকাশনী। তারা ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বিশ্বাস করেছি। আমি কি বলতে চাই তা শুনতে রাজি হয়েছিল। তারা আমার প্রথম বই, ‘উড়ন্ত আঙ্গুলগুলো’ প্রকাশ করেছে। এরপরের ঘটনার সূত্র ধরেই আমি আপনাদের সামনে। সেখান থেকে শুরু করে, শত শত স্কুলে বক্তৃতা দিয়ে, হাজার হাজার শিক্ষকদের জ্ঞান দিয়ে শেষে আজকে আপনাদের সামনে আমি।
শিশুরা বড় হয় এবং ঠিক আপনাদের মতই হয়। লক্ষ্য হচ্ছে, বাচ্চাদের আপনাদের মত বড় হয়ে যে ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠে। কোনো কিছুর অগ্রগতি যেভাবে হয়, তার কারণ হল নতুন প্রজন্ম এবং নতুন যুগ আগের চেয়ে আরও উন্নত হয়। এ কারণেই আমরা এখন অন্ধকার যুগে নেই। জীবনের যাত্রায় আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, শিশুদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। এরপর আমরা বড় হয়ে যাতে আপনাদেরকে চমকে সরিয়ে দিতে পারি।
বড়রা এবং সহ TEDsters, আপনাদের উচিৎ শিশুদের কথা শোনা এবং তাদের কাছ থেকে শেখা এবং আমাদেরকে বিশ্বাস করা এবং আমাদের কাছ থেকে আরও বেশি আশা করা। আপনাদের আজই কান পেতে দিতে হবে। কারণ আমরা আগামীর পথপ্রদর্শক। এর অর্থ আমরাই ভবিষ্যতে আপনাদের যত্ন নিতে যাচ্ছি।
আমরাই ভবিষ্যত প্রজন্ম। আমরাই ভবিষ্যৎ বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। নতুন নেতৃত্বের এবং নতুন চিন্তা-ভাবনার জন্য এ বিশ্বে সুযোগ প্রয়োজন। শিশুদের প্রয়োজন নেতৃত্ব দেওয়ার এবং সফল হওয়ার সুযোগ। আপনারা কি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রস্তুত?
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক, সাব্বিন হাসান