সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি ‘বাংলা টকিং টম’ চরিত্রটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কৌতুক করে টমকে দিয়ে বলানো হচ্ছে।
এই হাস্যকর ‘বাংলা টকিং টম’ – এর উদ্যোক্তার সন্ধান শুরু করি। পেয়েও যাই। সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিটা এখানেই। এ মানুষটিকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মানুষটির নাম আরমান উল হক। মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা করছেন মালয়েশিয়াতে। তখনই জানা যায় আরমান বহু আগে থেকেই সংগীতের সঙ্গে যুক্ত।
সংগীত বা মিউজিকের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি সবাইকে টমের মাধ্যমে হাসিয়েই যাচ্ছেন আরমান। আরমানের সঙ্গে অনলাইনে কথা হয় তার মিউজিক ও টম চরিত্রটি প্রসঙ্গে।
স্বপ্নযাত্রা বরাবরই চেষ্টা করে ভিন্ন ধরনের মানুষদের তুলে আনতে। যারা আপন মনে নিজ উদ্যোগে ভিন্ন কিছু করেন। তাদের প্রতি স্বপ্নযাত্রা সবসময় সম্মান জানায়। সেই আয়োজনের অংশ হিসেবেই আরমান উল হকের সঙ্গে আলোচনাটি তুলে দেওয়া হলো।
মিউজিকের প্রতি কবে থেকে ভালো লাগা তৈরি হলো? কীভাবে?
ভালোলাগা একদম ছোটবেলা থেকেই। বাবা আমাকে ছোটবেলায় কি-বোর্ড কিনে দিয়েছিলেন। বাবা একজন ডাক্তার। কিন্তু উনি খুব ভালো তবলা বাজাতে পারেন। তাই বাসায় তবলা ছিল।
আমি মাঝে মাঝে তবলা টুকটুক করে বাজাতাম। শব্দটা আমার অদ্ভুদ লাগতো। ৯৬ সালের ঈদে কিছু টাকা সালামি পেয়ে গিটার কিনলাম। কিন্তু গিটারটা ঘরেই পড়ে রইল। খুব একটা আগ্রহ পেলাম না।
বাবা বরাবরই সংগীতের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তি। তাই হয়তো পরের বছরই আমাকে ড্রামস কিনে দিল। এরপর ঘরে তো সবই আছে। অন্যদিকে আমার বড় ভাই ভালো গিটার বাজাতে পারতো। অনেক সময় রাতে আমি ভাইয়া এবং বাবা একসঙ্গে জ্যামিং করতাম। বাবা তবলা বাজাতো, ভাইয়া গিটার এবং আমি ড্রামস। মিউজিক যেন আমাদের জীবনরই অংশ হয়ে গেল।
তখনই কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এই বিষয়েই পড়াশোনা করবেন?
না তখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা করার আগ্রহ জন্মে ২০০৪ সালের দিকে। ইচ্ছে ছিল অডিও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বো। কিন্তু বাংলাদেশে এই বিষয়ে পড়াশোনা করার মত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
আমি অপেক্ষা করলাম যে হয়তো বাংলাদেশে কোনো ইউনিভার্সিটি এই বিষয়টি চালু করবে। কিন্তু হলো না। নিজেই আগ্রহ নিয়ে অনলাইনে বসে বসে পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। পরে ইচ্ছে জাগলো বিদেশে গিয়ে অডিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়বো।
মিউজিক নিয়ে প্রথম কিভাবে কাজ শুরু করলেন?
সাত বছর ড্রামস শেখার পর ২০০৩ সালে একটা ব্যান্ড তৈরি করলাম। নাম দেওয়া হলো ‘কাল্পলিক’। পড়াশোনার চাপের কারণে ব্যান্ডটা একসময় ছেড়ে দিতে হলো।
বেশ কিছু বছর মিউজিক থেকে দূরে থাকলাম। তবে আবার একটি ব্যান্ডে ড্রামার হিসেবে শো করা শুরু করলাম।
হুট করেই পিয়ানোর প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো। আমি কি-বোর্ডে পিয়ানোর ফরমেটে বাজানোর চেষ্টা করতাম। একদিন এলিটা করিমের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন আমরা একটা ব্যান্ড ফর্ম করি। নাম দেওয়া হয় ‘রিটেক’। এলিটা করিমের সঙ্গে বিভিন্ন শো’গুলোতে যেতাম এবং ড্রামস বাজাতাম।
কম্পোজিশন করতে ইচ্ছে ছিল বহু আগে থেকেই। সাহস করে নিজে নিজেই গান লেখা শুরু করি। পিয়ানো ও গিটারে নিজের লেখা গান উঠানোর চেষ্টাও চলতে থাকলো।
একদিন অর্থহীনের সুমন ভাই বলল ওনার একটি গান পিয়ানোতে রিমেক করে দিতে। গানটি ছিল ‘প্রতিচ্ছবি’। ওয়ারফেজ অ্যালবাম থেকে গানটি রেকর্ড করার পর ভূত এফএম অনুষ্ঠানে প্রচারিত হলো। এরপর আর কি! এভাবেই গানের সঙ্গে যুক্ত হলাম।
সম্প্রতি ‘বাংলা টম’ নিয়ে ইউটিউবে আপনি মজার মজার ভিডিও আপলোড করছেন। এই আইডিয়াটা কিভাবে মাথায় আসলো? গল্পটা বলেন।
বাঙালি টকিং টম হুট করেই করা হয়েছে। এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। খুব খারাপ লাগছিল। দেশের বাইরে থাকি। কথা বলার একটা মানুষও পাই না। তখন মোবাইল ফোনের টকিং টমের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাচ্ছিলাম।
মজা করার জন্য নিজেই কিছু ভিডিও রেকর্ড করে ফেসবুকে আপ করে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি অসংখ্য কমেন্ট ও শেয়ার হয়েছে। দেখে খুব ভালো লাগলো।
তখন ভাবলাম ভিডিওটি শুধু ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। এজন্যই ফেসবুক ফ্যান পেইজ খুললাম। এরপর আরো ভিডিও বানাতে থাকলাম।
মানুষের জীবনের সাধারণ কথা বলার বিষয়কেই বেছে নিয়ে আমি ‘বাংলা টকিং টম’ ভিডিও বানাই। আস্তে আস্তে ইউটিউবেও আপলোড করা শুরু করি। মানুষ হাসে। আনন্দ পায়। এ বিষয়টি আমাকে প্রচন্ড নাড়া দেয়। সিদ্ধান্ত নেই ভিডিও বানানো বন্ধ করা যাবে না।
এই মজার টমকে সবাই কিভাবে নিচ্ছে?
মজার বিষয় হলো পরের ভিডিওতে টমকে দিয়ে কি বলাবো সেই আগ্রহ নিয়ে অনেকেই অপেক্ষা করে। আরো ভালো লাগার বিষয় হলো, প্রতিটি মানুষই টমের কথার মধ্যে নিজের জীবনের ঘটনাকে খুঁজে পাওয়া শুরু করে।
এখনতো সবাই আমাকে আইডিয়া দেওয়া শুরু করেছে। কি করে টমকে দিয়ে মজার বিষয় তুলে ধরা যায় সেটা নিয়ে আলোচনারও তৈরি হয়েছে।
টমের কথা বলা বন্ধ করা যাবে না। টমকে দিয়েই আমি মানুষের জীবনের গল্প বলাবো। সবাইকে হাসাবো। মানুষ হাসলেই আমি খুশী। অন্যকে আনন্দ দেওয়ার চেয়ে বড় প্রাপ্তি পৃথিবীতে নেই। টমকে নিয়ে সামনে অনেক বড় প্রজেক্ট হবে। সেটা আপাতত গোপন থাকুক।
এবার মিউজিকে ফিরে আসি। সংগীত বা মিউজিক বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ নিয়ে কিছু বলেন।
বাংলাদেশে মিউজিক নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এটাই আমার দুঃখ। আমার মতো মিউজিক পাগল মানুষরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
আমার ইচ্ছে আছে, বিদেশি ইনস্টিটিউটগুলোকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে মিউজিক নিয়ে পড়াশোনার একটা ক্ষেত্র তৈরি করা। সেই সঙ্গে নিজেরও ইচ্ছে আছে একটি প্রতিষ্ঠান দেওয়া।
সবাই তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়। অথচ আপনি দেখেন, মিউজিকের ভেতরও ইঞ্জিনিয়ারিং আছে। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, অডিও ভিডিও ইঞ্জিনিয়ারিং। এগুলো তো কেউ জানেও না।
এ বিষয়গুলো পড়লে বাংলাদেশে কাজ করার মতো অনেক সুযোগ আছে। আমাদের দেশ মিউজিকে অনেক এগিয়ে আছে। শুধু একটু পড়াশোনার সুযোগ দিলেই হবে।
আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকমানের একটি মিউজিক স্কুল হবে। যেখানে গরীবরা বিনা পয়সায় পড়তে পারবে। যারা গরীব তাদের মধ্যেও তো সংগীত নিয়ে পড়ার আগ্রহ থাকতে পারে। তাদের ভেতরও তো প্রতিভা থাকতে পারে। তাদের জন্য আমি সব পথ খুলে দিতে চাই। হয়ত তাদের মধ্যে থেকেও অনেক সম্ভাবনা বের হয়ে আসবে। আমার সাধ্যে যদি আসে অবশ্যই আমি এধরনের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে তুলবো।
তরুণরা এখন নিত্য নতুন কাজ করে সবাইকে চমকে দিচ্ছে। সংগীতে কি তারা নতুন কোনো চমক দেখাতে পারবে বলে মনে করেন?
অবশ্যই। বাংলাদেশের তরুণরা এখন সংগীত বা মিউজিকের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
মজার বিষয় হলো, আমাদের প্রজন্মের কাছে অনেক সুযোগ। এবং এই সুযোগ আমরা গ্রহণ করছি। প্রতিযোগিতায় সবাই অংশ নিচ্ছি। তাই আগামী কয়েকবছরে দেখবেন মিউজিকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে। এটি করে দেখাবে আমাদের প্রজন্মই।
আমি তো বলবো, সংগীতে খুব শীঘ্রই চমক দেখবেন। আমরা সবাই মিলেই সেটা করে দেখাবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১২