ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

নীলফামারীর নারীদের তৈরি মাদুর যাচ্ছে বিদেশে

নুর আলম, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪০, মে ৩০, ২০১২
নীলফামারীর নারীদের তৈরি মাদুর যাচ্ছে বিদেশে

নীলফামারী: জাহেরা বেগম (৩০)। স্বামী, দুই সন্তান আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিয়ে ছিল তার অভাবের সংসার।

তিন বেলা পেট পুড়ে খেতেও পারতেন না। অনটনের সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো।

কিন্তু জাহেরা বেগমের সেই দিন আর নেই। ঘুঁচে গেছে প্রাত্যহিক অভাব-অনটন। উপরন্তু এখন তিনি স্বামী ও সংসারে সহযোগিতা করছেন। পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছেন।

জাহেরার বর্তমান এ অবস্থার পেছনে রয়েছে মাদুরের ভূমিকা। মাদুর তৈরি করে জাহেরা নিজে যেমন স্বাবলম্বী  হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন একজন প্রশিক্ষকও। তার হাত ধরে এলাকায় আরও ৭৫ জন নারী তৈরি করছেন মাদুর।

কর্মব্যস্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে নীলফামারী সদরের কুচকাটা ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া। দিনের যে কোনো সময়ে গেলেই চোখে পড়বে জাহেরা বেগম ছাড়াও জয়া বেগম, শিউলি আক্তার, মোর্শেদা বেগম, মারুফা আক্তার, সাবিনা ইসলামদের কর্মব্যস্ততা।

আর এখানে উৎপাদিত মাদুর নীলফামারী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় সমাদৃত হয়েছে। রপ্তানি হচ্ছে কানাডা, ডেনমার্ক, সুইডেন ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে। চাহিদা বাড়ায় মাদুর তৈরিতে দরিদ্র মহিলাদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে দিন দিন।
 
সরেজমিনে দেখা গেছে, আরডিআরএস’র ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সদস্য ছিলেন তারা। শুধু ঋণে নয়, মেধা এবং শ্রম দিয়ে উপার্জন করে নিজে এবং সমাজকে পরিবর্তন করা যায় এমন পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা সম্পৃক্ত হন মাদুর তৈরির প্রশিক্ষণে।

এ পর্যন্ত আরডিআরএসএ নীলফামারী সদরের ইটাখোলা, চওড়া, বড়গাছা এবং কচুকাটা ইউনিয়নের ২৭৫ জন নারী ৪৫ দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছেন মাদুর তৈরির কাজ। তাছাড়াও প্রশিক্ষণ নেওয়া ওই ২৭৫ জন নারী নিজ নিজ এলাকায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন আরও অন্তত ৫০০ দরিদ্র নারীকে।

এখন তারা সংসারের কাজের পাশাপাশি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মাদুর তৈরির কাজে। একটু পরিশ্রম করলেই যে পরিবর্তন এবং নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সে কথাই বললেন জাহেরা বেগম।

তিনি বলেন, ‘যখন এ কাজে আমি জড়িত ছিলাম না, তখন নানা সমস্যা লেগেই ছিল। স্বামীর একার উপার্জনে সংসারে অভাব অনটন থাকার পাশাপাশি সময়টা যেন বসে থেকেই কেটে যেত। মাদুর তৈরিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর উপার্জনের পাশাপাশি নিজেকে আলাদাভাবে গড়তে পারছি’।

জাহেরার শ্বশুর তহিদুল ইসলাম এলাকার নারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘সমাজের সব নারী এভাবে উন্নয়ন কর্মকা-ে নিজেদের সম্পৃক্ত করে, তাহলে গরিব মানুষগুলোর পরিবারে দুঃখ-কষ্ট থাকবে না’।

কচুকাটা পশ্চিমপাড়ার জয়া বেগম জানান, তারা প্রতিদিন মাদুর তৈরি করে ১১০ টাকা হারে মাসে ৩৩০০ টাকা উপার্জন করছেন। ইতোমধ্যে তাদের মাদুর তৈরির কাজ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও বিদেশি লোকজন দেখে গেছেন বলে জানান তিনি।

আরডিআরএস সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে এ প্রকল্পটি চালু হয় নীলফামারীতে। যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা নিজেরা ছাড়াও অন্যদের উৎসাহিত করে মাদুর তৈরিতে সম্পৃক্ত করছেন। সুতা সরবরাহ করে প্রশিক্ষিত ওই দরিদ্র নারীদের তৈরি করা মাদুর (ম্যাট) দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হচ্ছে। যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও সমাদৃত।

জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ছাড়াও ডেনমার্ক, কানাডা, ভারত এবং সুইডেনের দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা নীলফামারীতে তৈরিকৃত মাদুরের প্রশংসা করেছেন বলে জানান আরডিআরএস নীলফামারীর কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (ঋুদ্র ঋণ) গোলাম মোস্তাফা।

তিনি জানান, আর্থিক সঙ্কট দূর করার পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে নীলফামারীর দরিদ্র নারীদের কাছে মাদুর তৈরি এখন বেশ জনপ্রিয়। কচুকাটা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য বকুল সরকার জানান, অভাবের সংসারে সহযোগিতায় নারীদের এগিয়ে আসা খারাপ কিছু নয়। বরং যারা মাদুর তৈরি করছেন, তারা আমাদের অহংকার।

আরডিআরএস নীলফামারীর সমন্বয়কারী খন্দকার রাশেদুল আরেফীন জানান, প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর এলাকার নারীদের কর্মস্পৃহা অনেক বেড়েছে। এসব এলাকায় যখন মাঠে কাজ থাকে না, তখন গ্রামের এসব দরিদ্র নারীদের কাজের সন্ধান করতে হয় না। এছাড়াও পুরুষদের বাইরে কাজে যাওয়ার প্রবণতাও কমেছে।

দরিদ্র নারীদের কাজ দেখে অভিভূত হয়েছেন নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গোলাম আযম।

তিনি জানান, তার উপজেলায় মাদুর তৈরি ও প্রশিক্ষণে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়নোর ব্যাপারে তিনি উদ্বুদ্ধ করবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৮ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১২-০৫-৩০
সম্পাদনা: রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।