ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

লোকনাথের ১২২তম তিরোধান দিবসে বারদীতে ভক্তদের ঢল

তানভীর হোসেন, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৩২, জুন ২, ২০১২
লোকনাথের ১২২তম তিরোধান দিবসে বারদীতে ভক্তদের ঢল

নারায়ণগঞ্জ : ১৯ জৈষ্ঠ্য শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ১২২তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার বারদীতে লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রমে ভক্তদের ঢল নেমেছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে খ্যাত সাধক পুরুষ লোকনাথের তিরোধান দিবস পালন উপলক্ষে শনিবার (১৯ জৈষ্ঠ) থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ লোকজ মেলার আয়োজন করা হয়েছে।

কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এরই মধ্যে দোকানিরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন।

এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শনিবার ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে হাজার হাজার লোকনাথ ভক্ত আশ্রমে ভিড় করছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে লোকজনের সমাগমও।

এদিকে, একসঙ্গে এতো মানুষের আগমনের কারণে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর ও এশিয়ান হাইওয়ে সড়কে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। সোনারগাঁও থেকে বারদী যাওয়ার সবগুলো রাস্তায়ও যানজট রয়েছে।

তিরোধান উৎসব উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলেও কয়েকটি স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

শনিবার সকালে প্রভাতী কীর্তনের মধ্য দিয়ে তিরোধান উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর চলে পূজা অর্চনা, গীতা পাঠ, কীর্তন, রাজভোগ, বাল্য ভোগ ও প্রসাদ বিতরণ।

সকাল ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আরতী কীর্তন চলছিল।

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক শংকর কুমার জানান, তিরোধান উৎসবে অংশ নিতে এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা থেকেও বিপুল সংখ্যক লোকনাথ ভক্ত বারদী আশ্রমে এসে পৌঁছেছেন। তাদের থাকা ও খাওয়ার সুব্যাবস্থা করা হয়েছে এখানে।

এবার ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি ভক্ত এসেছেন বলে জানিয়েছেন আশ্রম কমিটির নেতারা।

সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, বারদী যাওয়ার সবগুলো পথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এজন্য পুলিশ, আনসার, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্যরা যৌথভাবে কাজ করছেন।

তিনি আরও জানান, ছিনতাইয়ের কোনো অভিযোগ তাদের কাছে করা হয়নি। যানজট নিরসনে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।

হিন্দু কল্যাণ সংস্থার নেতা সাংবাদিক ও পুরোহিত রনজিৎ মোদক বাংলানিউজকে জানান, লোকনাথ ব্রহ্মচারী ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ ও বাংলা ১১৩৭ সালের ১৮ ভাদ্র ভারতের পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত মহাকুমার অন্তর্গত চুরাশিচাকলা গ্রামে ধর্মীয় সাধক রামনারায়ণ ঘোষাল ও কমলা দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তাদের চতুর্থ সন্তান। জন্মের আগেই বাবা-মা লোকনাথকে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।   জন্মের পর ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখা ও পুঁথিগত বিদ্যার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না লোকনাথের। তিনি শুধু বন-জঙ্গল আর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন।

লোকনাথের যখন মাত্র ১০ বছর বয়স তখনই তাকে সর্বশাস্ত্র পারদর্শী সন্ন্যাসী ভগবান গাঙ্গুলীর হাতে তুলে দেন বাবা রামনারায়ণ।

প্রথমে তাঁরা আসেন কালীঘাটে, সেখান থেকেই দুই নবীন সন্ন্যাসীর সাধনা শুরু হয়। গুরু ভগবান গাঙ্গুলী প্রথমে শিষ্যদের নানা ব্রত পালন করতে শেখান। এর মধ্যে ছিল-নক্তব্রত, একান্তরা, ত্রিরাত্রী, পঞ্চাহ, নবরাত্রী, দ্বাদশাহ, পক্ষাহ, মাসাহব্রত। অর্থাৎ সারাদিন উপবাস থেকে রাতে আহার, এইভাবে একদিন, তিনদিন, পাঁচদিন, বারোদিন, পনেরদিন, শেষে টানা একমাস উপবাসের পরে আহার। এভাবে নানা ব্রত পালনের পর তাঁরা যান হিমালয় পর্বতে। এরপর দীর্ঘ নব্বই বছর বরফের উপর কঠোর সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন তাঁরা। এভাবে পূর্ণ-ব্রহ্মত্ব লাভের পর লোকহিতার্থে তাঁরা পায়ে হেঁটে পৃথিবীর নানা দেশ পর্যটন করেন।

লোকনাথের গুরু ভগবান গাঙ্গুলী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীর উদ্দেশে রওনা দেন। পথে পাকিস্তানের কাবুলে মোল্লা সাদি নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে লোকনাথের দেখা হয়। সেখানে সাদির কাছ থেকে লোকনাথ কোরআন শিক্ষা করেন। এ কারণে কাবুলে অনেক সমাদৃত হয়েছিলেন লোকনাথ। তিনি পবিত্র মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখেন।

পরবর্তীকালে তিনি জ্ঞান সাধনা ও সিদ্ধিলাভের জন্য হিমালয়ের দূর্গম পর্বতমালা, পবিত্র মক্কা শরীফ, কাশীধাম ও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে দীর্ঘ সময় ধ্যানমগ্ন ছিলেন।

বিশ্বপরিক্রমার পর বন্ধু বেণীমাধবকে সঙ্গে নিয়ে ১৩৩ বছর বয়সে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যান (১৮৬৩ খ্রিঃ)। সেখান থেকে বেণীমাধব চলে যান কামাখ্যায় আর লোকনাথ ব্রহ্মচারী লোকহিতার্থে অবতরণ করেন সমতলে- তাঁর লীলাক্ষেত্র নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদী গ্রামে।

লোকনাথ সোনারগাঁওয়ের স্থানীয় হিন্দু নেতা ডেঙ্গু কর্মকারের অনুরোধে বারদী এলাকায় আসেন। তখন তিনি বারদীতে বিভিন্ন লোকজনের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ওই সময়ে এবং বারদীর বিখ্যাত নাগ পরিবার সাধনার জন্য লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে এখানে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দেয়। লোকনাথ ব্রহ্মচারী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বারদী আশ্রমেই অবস্থান করেছিলেন।

আপনভোলা এই সন্ন্যাসীকে প্রথমে কেউ চিনতে পারেনি। একদিন দুই ব্রাহ্মণ যুবকের পৈতের প্যাঁচ লেগে গিয়েছিল, খুলতে পারছিল না। যুবক দু’জনের অনুরোধে সন্ন্যাসী লোকনাথ গায়ত্রী মন্ত্র জপের পর হাততালি দিতেই পৈতের প্যাঁচ খুলে যায়। এরপরই চারদিকে প্রচার হয়ে যায় অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এ মহাপুরুষের কথা। তিনি পরিচিত হন বারদী ব্রহ্মচারী নামে।

এমন কিছু অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি সাধারণ্যে আত্মপ্রকাশ করেন। মাঝে মধ্যেই তিনি বলতেন, আমাকে ঠাকুরের আসনে বসিয়ে তিনবেলা পূজা করার প্রয়োজন নেই। শুদ্ধ ভক্তিতে স্বরণমাত্র প্রত্যেকেই আমার সাড়া পাবে।

১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের (১২৯৭ বঙ্গাব্দ) ১৯ শে জ্যৈষ্ঠ ১৬০ বছরের পুরাতন মানবদেহ পরিত্যাগ করার আগে লোকনাথ সবাইকে বলে যান, আমি নেই এ কথা তোমরা  কখনো মনে করবে না- আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো।

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধানের পর থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে প্রতি বছর পালন করে আসছেন তার তিরোধান উৎসব।     

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১২
সম্পাদনা: শিমুল সুলতানা, নিউজরুম এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।