ঢাকা: ফরিদপুরের শিবচর উপজেলার আট বছরের শিশু শফিকুল ইসলাম । বাবা আব্দুল মজিদ দ্বিতীয় বিয়ে করে খোঁজখবর নেIয়া ছেড়ে দেয়| সেই সঙ্গে বন্ধ করে দেয় খরচও দেIয়াও।
গাবতলীর বাস টার্মিনালের পাশেই একটি বস্তিতে ঠাঁই হয় তাদের।
অজঁপাড়াগাঁ’য়ের নাসিমা কোন কাজ জানেন না, তবে রান্নাটা মোটমুটি করতে জানেন। বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ জোগাড় হলেও তাতে থাকা-খাওয়ার খরচে উঠে আসে না। বাধ্য হয়ে আদরের শিশুপুত্রকেও কাজে লাগিয়ে দেন নাসিমা। বাসের বডি মেরামতকারী মিস্ত্রির সহকারী, মাসে বেতন পাঁচশ’ টাকা।
এরই মধ্যে শফিকুলের সঙ্গে সাক্ষাত ঘটে পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পি এস টি সি )‘র ‘হেলপিং চিলড্রেন ওয়ার্কিং অ্যান্ড লিভিং অন দি স্ট্রিট’ প্রকল্পের কর্মীদের। তারা শফিকুলকে নিয়ে যায় পি এস টি সি’র গাবতলী পথশিশু ড্রপিং ও শেল্টার সেন্টারে।
সেখানেই শফিকুল নিয়মিত পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন ছবি আঁকা, গান শেখা ইত্যাদি মেধা বিকাশ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমেও যুক্ত হয়। অল্প সময়ে সে ছবি আঁকায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। দারিদ্র আর পারিবারিক বিশৃঙ্খলার মাঝেও এগিয়ে চলে শফিকুলের মেধা ভিত্তিকচর্চা।
পি এস টি সি’র আয়োজনে জাতীয় জাদুঘরের নলীনিকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী গ্যালারিতে শুরু হওয়া তিনদিনের পথশিশুদের ছবি আঁকা প্রদর্শনীর সমাপনী অনুষ্ঠানে সোমবার কথা হচ্ছিল শফিকুলের সঙ্গে। অন্য পথশিশুদের মত সেও এসেছে নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনীতে।
সে জানালো জীবনে অনেক বড় হওয়ার আকাঙ্খাও আছে তার মনে। শফিকুল জানায়, ‘বড় অইয়্যা ডাক্তার অমু, মানুষ গো ঔষুধ দিমু’।
শফিকুলের মতই নানা বঞ্চনার শিকার পথশিশুরাও নিজেদের আঁকা ছবি নিয়ে হাজির হয়েছিল জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে। গ্যালারিতে শহুরে অভিজাত আর শিক্ষিত মানুষেরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ এসব শিশুদের আঁকা ছবি দেখে। তাদের আঁকা ছবি দেখতে এতো মানুষের ভিড় যেন আরো বাড়িয়ে দিলো পথশিশুদের মনোবল।
পি এস টি সি’র খিলগাঁও মায়াকানন ড্রপিং ও শেল্টার সেন্টারে ছাত্রী লিজা আক্তার (১৪)। বাবা বিল্লাল হোসেন কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। বাবার সামান্য আয়ে সংসার কোন রকম চলে। ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার খরচ যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তো।
এমন কঠিন সময়ে পি এস টি সি’র ড্রপিং ও শেল্টার সেন্টার লিজার পড়াশুনায় এগিয়ে আসে। এখানেই ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয় তার ছবি। অনুভূতি জানাতে যেন মুখের ভাষাই হারিয়ে ফেলে লিজা। সে জানায়, ‘অনেক ভাল লাগছে। সুযোগ পেলে আরো ভাল করতে পারমু’।
পি এস টি সি’র পথশিশুদের এই কার্যক্রমের নানা দিক নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর তাহমিনা বানু।
তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালে পি এস টি সি প্ল্যান বাংলাদেশের সহায়তায় পথশিশুদের জন্য এই উদ্যোগ হাতে নেয়। রাজধানীতে বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ পথশিশু বা ছিন্নমূল শিশু রয়েছে। প্রতি বছর আমরা রাজধানীর ২৬০০ ছিন্নমূল শিশুকে এই কার্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করার টার্গেট নিয়ে কাজ করে থাকি। রাজধানীতে আমাদের ১৩টি ড্রপিং ও শেল্টার সেন্টারে এদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাবার-বাসস্থানসহ অন্যান্য সেবা প্রদান করা হয়। ’
তাহমিনা বানু এসব শিশুদের পথশিশু হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘মূলতঃ বাবা-মা’য়ের বিচ্ছেদ, অতিদারিদ্র, সংসারে সৎ মা বা বাবার অত্যাচার ইত্যাদি কারণেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে এসব শিশু। ’
পথশিশুদের মধ্যেও আশ্চর্য রকমের মেধা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর আগে শিশু অধিকার সপ্তাহে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় আমাদের কেন্দ্রের এক শিশু চতুর্থস্থান অধিকার করে। শহরের অভিজাত পরিবারের শিশুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হচ্ছে এরা, যাদের পেটে খাবার পর্যন্ত নেই। ’
তাহমিনা আরো জানান, ‘এসব শিশুর কেউ কেউ সামান্য উপার্জনের সঙ্গেও যুক্ত। আমরা এতে বাধা দেই না, তবে ঝুঁকিমুক্ত কাজ করতে উৎসাহিত করি। ’
তিনি বলেন, ‘যারা আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষে শিক্ষার মূল ধারায় সম্পৃক্ত হতে চায়, আমরা তাদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। কেউ পরিবারে ফিরে যেতে চাইলে আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে শিশুদের তাদের পরিবারে ফিরিয়ে দিই। অনেককে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে স্থায়ী কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তাছাড়া তাদের উপার্জিত অর্থ অনলাইন সেভিংস এরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা সঞ্চয়ও করতে পারবে। ’
বাংলাদেশ সময়ঃ ২০৫০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১২
এআই/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর