ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘সৌদিতে আছে সোনা, মেঘনায় গলদার পোনা’

কাজল কায়েস, রায়পুর সংবাদদাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২৭, জুন ৬, ২০১২
‘সৌদিতে আছে সোনা, মেঘনায় গলদার পোনা’

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) : রায়পুর উপজেলার চরবংশী গ্রামের জেলে আবদুল আজিজ বলেন, ‘সৌদি আরবে আছে সোনা, আর আমগো মেঘনা নদীতে আছে গলদা চিংড়ির পোনা। এ পোনার কারণে আমগো জেলেদের বাইগ (ভাগ্য) খুলি গেছে’।



লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদী ও সংযোগ খাল থেকে মৌসুমে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার গলদা চিংড়ি পোনা আহরণ করা হয়। এতে জেলে, ফড়িয়া ও আড়তদারদের সত্যিই ভাগ্য খুলেছে। কিন্তু নির্বিচারে পোনা নিধনের ফলে মেঘনার মৎস্য সম্পদের জন্য তা বড় ক্ষতি বয়ে আনছে।

নিষিদ্ধ হলেও বছরের চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত মেঘনা পাড়ের প্রায় ১০ হাজার জেলে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করে। এ সময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রচুর পোনা নষ্ট করে ফেলা হয়।

জেলেদের সংগ্রহ করা পোনা কেনার জন্য যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা থেকে মৌসুমের শুরু থেকে প্রতিদিন ব্যবসায়ীরা নদীর তীরে ভিড় জমায়।

পোনা আহরণ
মেঘনার চাঁদপুরের হাইমচর থেকে রামগতির আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নদী এলাকায় গলদা চিংড়ি পোনার অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত এ চিংড়ি চাষের উপযুক্ত সময়। এতে এ মৌসুমে মেঘনা পাড়ের প্রায় ১০ হাজার জেলে মশারি, নেট জাল, ছাকনি ও চাদর দিয়ে এ পোনা আহরণ করে।

জেলে মাহাবুব হোসেন ও সোহেল মিয়া জানান, একজন জেলে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০০ হাজার পোনা ধরতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে যায় এ পোনা। যে কারণে প্রতি মৌসুমেই মেঘনা পাড়ে গলদা চিংড়ি পোনা আহরণকারীদের ভিড় লেগে যায়।

মেঘনার পোনার ব্যাপক চাহিদা
চিংড়ি চাষিদের কাছে মেঘনা নদীর গলদা চিংড়ি পোনার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ পোনা ৩-৪ মাসের মধ্যেই বিক্রির উপযুক্ত হয়ে যায়। এ সময় ৪-৫টি চিংড়ি ১ কেজি ওজনের হয়ে যায়। এতে চিংড়ি চাষিরা অল্প সময়ে বেশি লাভবান হন।

১০ বছর ধরে চিংড়ি পোনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, মেঘনা নদীর গলদা চিংড়ির পোনা অল্প সময়ে বড় হয়ে যায়। এজন্য চিংড়ি ঘের মালিকদের কাছে মেঘনার পোনার কদর বেশি। প্রতি মৌসুমে এখানে ১৫০ কোটি টাকার গলদা চিংড়ির পোনা কেনাবেচা হয় বলে জানা গেছে।

পোনার হাট
মেঘনা নদী এলাকায় প্রতি মৌসুমে গলদা চিংড়ির পোনার প্রায় ১৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। পোনা সংগ্রহ করার জন্য দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। এ ব্যবসা ঘিরে নদীর পাড়ের হাজিমারা, পানিরঘাট, নতুন ব্রিজ, বালুরচর ও মেঘনার বাজারে  প্রতিদিন হাট বসে।

ব্যবসায়ীরা জেলেদের কাছ থেকে প্রতিটি পোনা ১ থেকে ১ টাকা ৫০ পয়সা দরে কেনেন। তারা ড্রাম ও বড় পাতিল ভর্তি করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ে চিংড়ি ঘের মালিকদের কাছে প্রতিটি পোনা বিক্রি করেন দুই থেকে আড়াই টাকায়।

পোনা ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন বলেন, ‘গলদা চিংড়ির পোনা ধরা যে অবৈধ, তা আমরাও জানি। এ ব্যবসায় আমাদের লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত আছে কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ’।
 
আড়তদারের হাত হয়ে চিংড়ি ঘেরে
রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদী এলাকার হাজিমারা, নতুন ব্রিজ, পানির ঘাট, বালুর চর ও মেঘনার বাজারে ৫০টি পোনার আড়ৎ রয়েছে। জেলেরা নদীতে গলদার পোনা ধরে এসব আড়ৎতে এক থেকে দেড় টাকা বিক্রি করে। আড়ৎদার খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের আড়ৎদারের কাছে প্রতিটি পোনা বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই টাকা। তাদের কাছ থেকে গলদার পোনা কিনে নেয় চিংড়ি ঘের মালিকরা।

চিংড়ি পোনার আড়ৎদার আবদুর রহিম বলেন, ‘মৌসুমে তিন মাস গলদা চিংড়ির ব্যবসা হয়। প্রতি বছর এ ব্যবসায় আমার লেনদেন হয় ৬০-৭০লাখ টাকা’।

বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধংস
মশারির জাল দিয়ে নদীর পানি ছেঁকে গলদার পোনা ধরা হয়। এসব পোনা ধরার সময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা ও ডিম মশারিতে উঠে আসে। চিংড়ির পোনা বাছাইয়ের পর অন্য মাছের  ডিম ও পোনা অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়।

রায়পুর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘এভাবে পোনা নিধন অব্যাহত থাকলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বৈচিত্র্য হারিয়ে মেঘনা নদী মাছশূন্য হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। গলদা চিংড়ির পোনা ধরা নিষিদ্ধ। পোনা নিধন প্রতিরোধে মেঘনায় অভিযান চালানো হবে’।  

তৎপরতা নেই প্রশাসনের
গলদা চিংড়ি পোনা ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু থেমে নেই পোনা ধরা। প্রতিদিন হাজারো মানুষ মশারির জাল দিয়ে নদীর পানি ছেঁকে ওই পোনা ধরছে। অবাধে পোনা নিধন চললেও প্রশাসন এ জন্য এখনও অভিযান  চালায়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলার হাজিমারা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ফরহাদ হোসেন বলেন, মেঘনা নদীর পাড়ে গলদা চিংড়ির পোনা বিক্রি হয় বলে শুনেছি। অবৈধ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৪ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১২

সম্পাদনা: রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।