দীর্ঘদিনের অযত্ন অবহেলায় ক্রমশঃ বিলীন হওয়ার পথে প্রাচীন কালের স্বাধীন রাজ্য জৈন্তার (জৈন্তিয়াপুর) ঐতিহ্য, প্রত্নসম্পদ ও পুরাকীর্তি। এসব প্রত্নসম্পদ রক্ষায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকা যখন মোগল সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল তখনও জৈন্তিয়াপুরের ছিল স্বতন্ত্র অবস্থান। এখানে মানুষের বসতি ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। ১৫০০-১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ২৩ জন খাসিয়া রাজা জৈন্তিয়া শাসন করেন।
১৬৮০ সালে রাজা লক্ষ্মীনারায়নের সময় জৈন্তিয়া রাজ্যের রাজধানী পর্বত থেকে নিজপাটে স্থাপন করা হয়। নিজপাট ছিল সমতল অঞ্চল। তবে মেঘালয় পাহাড়ের নর্থিয়াংপুঞ্জিতে এই রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল। সিংহের প্রতিমূর্তি জৈন্তিয়ার রাজকীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হত।
নিজপাট নগরীতে রাজধানীর অবস্থান ছিল খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পর্বতের পাদদেশে। নগরীর উত্তর ও পশ্চিমদিকে নয়াগাং, পূর্বে নাগড়তি ছড়া এবং দক্ষিণে বড়গাং প্রবাহিত ছিল। সুগভীর পরিখাবেষ্টিত ছিল রাজধানী নিজপাট। কালের আবর্তনে এই পরিখাগুলো ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং জঙ্গলাময় হয়ে উঠছে।
১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রাজা রামসিংহের শাসনকালে জৈন্তিয়ার বিভিন্ন স্থানে বহু মঠ-মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজধানী শহর ৫২টি গলি বা পাড়ায় বিভক্ত ছিল। এখনও এই ৫২ গলির দেখা পাওয়া যায়। রাজবাড়ীর চারদিকে পরিখা খনন করে সুরক্ষিত করা ছিল। এর ভিতরে খননকৃত কূপ, নরবলি দেওয়ার স্থান, বিচারালয়সহ অনেক মূল্যবান পাথর রাখা ছিল।
রাজা রামসিংহের শাসনামলে স্থাপিত পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে সারীঘাট এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ঢুপির মঠের টিলা অন্যতম। রামসিংহ ধর্ম বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় ১৭৭৮ সাল ঢুপি পাহাড়ের একটি শৈল খণ্ডের উপর শিল্পশোভিত সুউচ্চ শিবমন্দির স্থাপন করা হয়। শিবমন্দিরটি ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যেত।
১৮৯৭ সালে আসাম অঞ্চলের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মন্দিরের চূড়াটি ভেঙ্গে যায়। এখনও ওই মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের চিহ্ন বিদ্যমান। ঢুপির মঠের পাদদেশে রাম সিংহের খননকৃত পুকুর এবং একটি পান্থশালার অস্তিত্বও বিদ্যমান আছে।
১৮৩৫ সালের ১৬ মার্চ। হ্যারি সাহেব নামক ইংরেজ চুনাপাথর ব্যবসায়ী জৈন্তিয়ার রাজধানী নিজপাট শহরে এসে রাজা রাজেন্দ্র সিংহকে কূট-কৌশলে বিনা যুদ্ধে নিরস্ত্র ও বন্দি করেন। এদিন জৈন্তিয়া রাজ্যের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। রাজঅন্তঃপুর থেকে বহু মূল্যবান সম্পদ লুট করে নিয়ে যায় ইংরেজেরা।
জৈন্তার বহুমূল্যবান প্রাচীন নিদর্শন রাজবাড়ি, রাজপ্রাসাদ, রামসিংহের শাসনামলের অনেক পুরাকীর্তি ও তৎকালীন জৈন্তা রাজ্যের নানা স্থাপনা, মেঘাতিলক, কালাপাথর ও বিজয়সিংহ মহারাজার স্মৃতি মন্দিরসহ রাজ্যের পুরাতন নিদের্শনগুলো সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হতে চলেছে। রাজবাড়ীর অনেক পুরাকীর্তি নষ্ট ও রাজবাড়ির জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
পুরাকীর্তিগুলো দেখার জন্য প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক পর্যটক এখানে আসেন। এছাড়া সিলেট-তামাবিল সড়কের সারিঘাটে অবস্থিত ঐতিহাসিক পান্থশালাঘর পর্যটকদের কাছে খুবই আর্কষণীয়। জাফলং ভ্রমণের সময় বেশিরভাগ পর্যটক একনজর পান্থশালাঘর পরিদর্শন করে যান।
২০০৭ সালের ২৩ মার্চ জৈন্তপুরে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের সারিঘাটের ঢুপি গ্রামের একটি নালা খনন করার সময় শিলালিপিটির সন্ধান পায় গ্রামবাসী। উদ্ধারের পর জানা গেছে শিলালিপিটি ৩শ বছর পূর্বের। এটি ১৭১৯ সালে তৈরি করা। পাঁচ ইঞ্চি পুরু শিলালিপিটি লম্বায় ২২ ইঞ্চি ও প্রস্থে ১৫ ইঞ্চি। এর ওজন প্রায় ৩৫ কেজি।
শিলালিপির গায়ের কারূকাজ দেখতে খুবই সুন্দর। জমিনে পানপাতা আঁকা। এতে সংস্কৃত ভাষায় বেশ কিছু লেখা পাওয়া যায়। পরে শিলালিপিটি উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জাতীয় যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এই শিলালিপি উদ্ধারের পর উপজেলা প্রশাসন জৈন্তাপুরের জৈন্তেশ্বরী বাড়িকে যাদুঘরে রূপান্তর করার ঘোষণা দেয়। একটি সাইনবোর্ডও টানানো হয়।
তবে, ওইটুকুই ব্যাস। এ ব্যাপারে আর কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। জৈন্তার প্রত্নসম্পদ রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী এসব সম্পদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে অচিরেই।
বাংলাদেশ সময় : ১৮১৯ ঘণ্টা, ০৯ জুন, ২০১২
সম্পাদনা : মুনিফ আম্মার, স্টাফ রিপোর্টার; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর