বিশ্বজুড়ে শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন বহু মানুষ ও প্রতিষ্ঠান। ‘পরিক্রমা হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’ তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান।
ভারতের ব্যাঙ্গালোরে ১৯৯২ সালে পরিক্রমার যাত্রা শুরু হয়। কয়েকজন বন্ধু মিলে এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন শুক্লা বসু। স্বপ্নযাত্রার পাঠকদের জন্য ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক টেড সম্মেলনে শুক্লা বসুর দেওয়া ভাষণটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো।
আজ আপনাদের বলবো আমার পথ চলার গল্প। আমি কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একাডেমিক নই। অভিজ্ঞ কোনো সমাজকর্মীও নই। আমি ২৬ বছর কর্পোরেট জগতে কাজ করেছি। চেষ্টা করেছি কিভাবে প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা যায়। এটিই আমার যোগ্যতা। এরপর শুরু করলাম ‘পরিক্রমা হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের শুরু আমার রান্নাঘর থেকে।
ফাউন্ডেশনের প্রথম কাজ হিসেবে আমরা বস্তিগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমরা সবগুলো বস্তিতে যেতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছি বেশি সংখ্যক বস্তিতে যাওয়ার। এমন সব বাসা খুঁজে বের করেছি যেখানে ছেলে-মেয়েরা কখনোই স্কুলে যায়নি। আমরা বাবা-মায়েদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।
শুরুর দিকে আমরা খুবই উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু সংখ্যাগুলো দেখে থমকে গেলাম। দুই কোটি শিশু স্কুলে যায় না। অথচ এদের বয়স চার থেকে চৌদ্দ বছরের মধ্যে। দশ কোটি শিশু স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু পড়তে পারেনা। সাড়ে বারো কোটি শিশু সাধারণ অংক করতে পারেনা।
আমরা আরো শুনেছি যে পঁচিশ হাজার কোটি ভারতীয় রুপি সরকারী স্কুলগুলোর পেছনে বরাদ্দ হয়। এই অর্থের ৯০ শতাংশ খরচ হয় শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন হিসেবে। এখানে প্রতি চারজনে একজন শিক্ষক সারা বছরে একদিনের জন্যও স্কুলে যান না।
এই পরিসংখ্যান মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। তারপরও আমরা পাহাড়সম কাজে হাত দিলাম। এবং বললাম, ‘পরিসংখ্যান নিয়ে খেলাটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ’ আমরা একটি শিশুর দায়িত্ব নেব। আমরা তাকে সরাসরি স্কুলে পড়াবো। কলেজে পাঠাবো। তাকে একটা সুন্দর জীবন এবং সুন্দর জীবিকার জন্য প্রস্তুত করব।
এভাবে শুরু হলো আমাদের পরিক্রমার পথ চলা। পরিক্রমার প্রথম স্কুলটা ছিল একটি বস্তিতে। সেখানকার ৭০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো। আমাদের প্রথম স্কুল ওই বস্তির মধ্যে দোতলা বাড়ির ছাদে ছিল। আর সেই ছাদের উপরে কোনো পাকা ছাউনি ছিল না। শুধু ছিল অর্ধেক টিন শেড। সেটাই ছিল আমাদের প্রথম স্কুল। ছাত্রসংখ্যা ১৬৫ জন।
ভারতে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জুনে। জুন মাসে বৃষ্টি হয়। মাঝেমধ্যেই আমরা সবাই টিন শেডের নিচে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কারণ তখন বৃষ্টি হতো। আমরা সবাই বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। সেদিন আমরা সবাই যারা এক ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম; আজও আমরা সবাই একসঙ্গেই আছি।
এরপর তৈরি হলো দ্বিতীয় স্কুল। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ। এভাবেই তৈরি হলো জুনিয়র কলেজ। ছয় বছর পরে এখন আমাদের চারটা স্কুল এবং একটা জুনিয়র কলেজ আছে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা এগারোশো জন।
আমাদের স্বপ্নটা খুবই সাধারণ। প্রতিটি শিশুকে যেন স্কুলে পাঠাতে পারি। তৈরি করতে পারি বাঁচার জন্য। শিক্ষিত হবার জন্য এবং একই সঙ্গে শান্তিতে বাঁচার জন্য। তৈরি করতে পারি যুদ্ধে ভরা বিশৃঙ্খল বিশ্বায়নের যুগের সঙ্গে লড়তে। ইদানিং বিশ্বায়নের কথা বললেই ইংরেজির কথাও চলে আসে। তাই আমাদের সবগুলো স্কুলই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। তাদের একটি ধারণা হলো, বস্তির ছেলে-মেয়েরা ভালো ইংরেজি বলতে পারেনা। কারণ তাদের পরিবারে কেউ কখনো ইংরেজিতে কথা বলেনি। তাদের প্রজন্মে কেউ কখনো ইংরেজিতে কথা বলেনি। কিন্তু এই ধারনাটা ভুল!
আমাদের আরো একটা ভুল ধারনা আছে। সেটি হলো, বস্তির বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে আগ্রহী নয়। বরং তারা শুধু চায় সন্তানদের দিয়ে কাজ করাতে। এটাও সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। পুরো পৃথিবীজুড়ে সব বাবা-মা চায়, তাদের সন্তান যেন তাদের চাইতে ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারে। তবে তাদের বিশ্বাস করাতে হবে যে, পরিবর্তনটা আসলেই সম্ভব।
একবার আমাদের কাছে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মায়েরা এসে বললেন, ‘আমরা লেখাপড়া শিখতে চাই। আপনারা শেখাতে পারবেন?’ আমরা স্কুলের পরে ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম অভিভাবকদের জন্য, মায়েদের জন্য। ২৫ জন মা নিয়মিত লেখাপড়া শিখতে আসেন আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে।
আমাদের শিক্ষার্থীদের বাবাদের ৯৮ ভাগই মদ খায়। তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন, কত কষ্টকর এবং ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা আমাদের কাছে আসে। আমরা এই বাবাদের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাতে হয়েছে। তারপর তারা যখন ফিরে আসে নেশামুক্ত হয়ে তখন আমরা তাদের চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করি।
আমাদের স্কুলে এরকম তিনজন বাবা আছেন, যাদের আমরা রান্নাবান্না শিখিয়েছি। আমরা তাদের পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি বিষয় জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন তারা স্কুলে বাচ্চাদের খাবার সরবরাহ করে। তারাও কাজটা খুব ভালোমত করে। কারণ তাদের বাচ্চারাই এই খাবারগুলো খাচ্ছে। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জীবনে এই প্রথম তারা সম্মান পাচ্ছে।
আমাদের স্কুলের ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলাতেও খুব ভালো করছে। ভাল থেকে আরো ভাল করছে। ব্যাঙ্গালোরে প্রতি বছর ইন্টার স্কুল অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা হয়। শহরের সেরা ১৪০টি স্কুল থেকে ৫ হাজার শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। আমাদের স্কুল গত তিন বছর ধরে সেরা স্কুল এর পুরস্কার পেয়ে আসছে।
যখন পরিক্রমার কাজ শুরু করি তখন নিজেরাও জানতাম না আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। তবে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে আজ যেটা চাই সেটা হলো একবারে একজন করে শিশুকে দিয়ে শুরু করা। সংখ্যা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাবোনা। আমরা দেখতে চাই শিশুটি তার পরিপূর্ণ জীবন চক্র সম্পূর্ণ করুক। এবং তার সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে বের করে আনুক। আমরা আকারে বিশ্বাস করিনা আমরা বিশ্বাস করি কোয়ালিটিতে। সংখ্যা বৃদ্ধি আপনা আপনিই হবে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন আমাদের সাহায্য করছে। আমরা এখন আরও অনেক স্কুল খুলতে সক্ষম।
আমি যখন পরিক্রমার কাজ শুরু করি তখন আমার মধ্যে এক ধরণের ভাবনা কাজ করতো। সেটা ছিল, আমি পুরো পৃথিবীকে বদলে দেব। কিন্তু আজ, আমি নিজেই বদলে গেছি। আমার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমিও পাল্টে গেছি। আমি ওদের কাছ থেকে কত কিছু যে শিখেছি! ভালোবাসা, সহানুভূতি, কল্পনাশক্তি, আর এমন সৃজনশীলতা।
ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক