১৩ কে বলা হয় আনলাকি থার্টিন। ‘অপয়া ১৩’ কথাটির সত্যমিথ্যা যাচাই না করেই গজল ভক্তরা এখন থেকে অন্তত ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন যে ২০১২ সালের জুন মাসের ১৩ তারিখটি ছিল অপয়া।
চলতি বছরের শুরুর দিকেও সম্রাটের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল। সেই গুজবটিও ছড়িয়েছিল এক ১৩ তারিখে অর্থাৎ গত জানুয়ারির ১৩ তারিখে। পরে অবশ্য তাঁর ছেলে আসিফ মেহেদী সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তিনি বেঁচে আছেন এবং তার চিকিৎসা চলছে।
গত একযুগ ধরে ফুঁসফুঁসে সম্যা ও মূত্রনালী সংক্রমণজনিক কারণে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
তাঁর পরবর্তী উপমহাদেশীয় গজল গায়কদের অনেককেই ভক্ত-পৃষ্ঠপোষকরা ‘গজল সম্রাট’ উপাধী দিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবতাটা হচ্ছে, প্রকৃত গজল সম্রাট বলতে মেহেদী হাসানকেই বোঝেন সবাই। তার অসাধারণ কণ্ঠ মাধুর্য্য আর গায়কী মুহূর্তেই যে কোনো শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। মেহেদী হাসানের গজলের ইন্দ্রজালে কেই একবার ধরা দিলে শোনার অন্য সব খ্যাতিমান গায়কদের সেরা সেরা সৃষ্টিও পানসে ঠেকে।
তাঁকে সর্বকালের সেরা গজল শিল্পী হিসেবে মেনে নিয়েছেন সবাই। মেহেদী হাসান খাঁ সাহেবই শেহেনশাহ-ই-গজল।
ভারতীয় সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তী লতা মুঙ্গেশকর মেহেদী হাসানের কণ্ঠকে ঈশ্বরের কণ্ঠের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “দ্য ভয়েস অব গড!” আর পরলোকগত অপর কিংবদন্তী মোহাম্মদ রফি গজল বাদশাহ মেহেদী হাসান সম্পর্কে বলেন, “আমরা গান গাই সাধারণ মানুষের জন্য আর মেহেদী হাসান গান আমাদের জন্য। ”
মেহেদী হাসান বিষয়ে মোহাম্মদ রফির মুগ্ধতার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের আরও লাখ-কোটি ভক্তের মত মেহেদীর গজল না শুনলে রাতে তারও ঘুম আসতো না। একথা প্রমাণ দেয়, মেহেদীর কণ্ঠ কতটা যাদুকরী প্রভাব ধারণ করে।
২০১০ সালের অক্টোবরে এইচএমভি প্রকাশ করে মেহেদী হাসানের সর্বশেষ অ্যালবাম ‘সারহাদেঁ’। এই অ্যালবামে লতা মুঙ্গেশকরের সঙ্গে তার একটি দ্বৈত বা ডুয়েট গান আছে ‘তেরা মিলনা’ নামে। ফারহাদ শাহজাদের লেখা এই গানটির সুরারোপ করেছেন খাঁ সাহেব নিজেই। এই গানটিতে মেহেদী হাসানের কণ্ঠ রেকর্ড করা হয় ২০০৯ সালে পাকিস্তানে এবং ২০১০ সালে ভারতে লতা তার অংশটুকু গান। পরে তা মিক্সিং করে ডুয়েটে রূপান্তর করা হয়।
এদিকে, কিছুদিন আগে লতা নয়াদিল্লির এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করেন, মেহেদী হাসানের সঙ্গে কোনো ডুয়েট গাইতে পারেননি বলে। তাঁদের দুজনেরই ডুয়েট গান প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও লতার এ আক্ষেপের কারণ হল, মেহেদীর সাক্ষাৎ উপস্থিতিতে গাইতে পারেননি তিনি অর্থাৎ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গাইতে পারেননি বলে।
একজন কিংবদন্তী শিল্পীর প্রতি অপর এক কিংবদন্তীর এই শ্রদ্ধা আর মূল্যায়ন বলা যায় অতুলনীয়। পরষ্পর চিরবৈরী দু’টি দেশের বাসিন্দা হয়েও লতাজী যে অনুভূতি দিয়ে মেহেদী হাসানের সঙ্গে গাইতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন— তাতেও প্রকাশ হয় মেহেদী হাসান কোন মাপের শিল্পী ছিলেন।
“মাগার মুঝে কাভি তুম ভুলা না পাওগি”
শুধু কি বড় মাপের শিল্পী! একজন মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। এর বর্ণনা ধীরে ধীরে এ লেখায় পাবো। অভিজাত সাঙ্গীতিক পরিবারের সন্তান হয়েও তাকে পরিবারের দুঃসময়ে মোটর গাড়ি মেরামতের কারখানায় কাজ করতে হয়েছে। অর্থাৎ গুণী একজন শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও জীবন যুদ্ধে তিনি ছিলেন লড়াকু সৈনিক।
রাজস্থানের লুনা গ্রামে ১৯২৭ সালে সঙ্গীতমুখী খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আজিম আলি খান ও চাচা ইসমাইল খানের সঙ্গীত গুরু হিসেবে খ্যাতি ছিল। ফলে শিশু অবস্থা থেকেই সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়ে যায় তার খেয়োলে-বেখেয়ালে। তার ভেতরকার প্রতীভার সন্ধান পেয়ে চাচা ইসমাইল খান বিশেষ যত্ন নেওয়া শুরু করেন। চলতে থাকে সঙ্গীতের তালিম। চাচা তাকে তালিম দেওয়ার একপর্যায়ে সঙ্গীতের প্রতি, সুরের প্রতি অভিনিবেশ বাড়ানোর জন্য শিশু মেহেদীকে গ্রামের পাশের জঙ্গলে একা ফেলে রেখে আসতেন। ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেহেদী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ম্যায়নে বহুৎ কুচ দেখা, মাগার ডারা নাহি। অর্থাৎ আমি অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু ভয় পাইনি।
অর্থাৎ বাপ-চাচারা প্রতিভাবান মেহেদীর মেধাকে শান দেওয়া শুরু করেন সেই শিশুকাল থেকেই।
এর ফলে মাত্র আট বছরের শিশু মেহেদী মঞ্চে ধ্রুপদি ও খেয়াল সঙ্গীত পরিবেশন করে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করেন। এরপর ছিল স্বপ্নবাঁধানো সোপানে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু প্রতিভাবান এই শিল্পীর ভাগ্যে অন্য আরও অনেক প্রতিবাবানের মতই চরম পরীক্ষাকাল উপস্থিত হয়।
৪৭ এর দেশভাগ অনিবার্য সঙ্কট এনে দেয় মেহেদীর পরিবারে। ভারতে ছেড়ে নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানে চলে আসেন খাঁ’রা। পাকিস্তানে গিয়ে ২০ বছরের টগবগে যুবক মেহেদির জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতিটা হয়ে ওঠে চরম অস্বস্তিকর। এই বয়সটায় একজন মানুষ তার কেরিয়ার গড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে। কিন্তু জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া যুবক তার পরিবারের মতই অনিশ্চিত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মুখে পড়েন। নতুন দেশ, অচেনা মানুষ। নয়া দেশ পাওয়ার সাময়িক উত্তেজনা শেষে পেট চালানোর তাগিদে সাইকেল মেরামতে দোকানে কাজ নেন। এরপর কাজ করেন মোটর গাড়ি মেরমাতের কারখানায়ও। অর্থাৎ মোটর মেকানিকও বনতে হয়েছে তাঁকে।
গাড়ির মেকানিক বনে যাওয়া মেহেদীর মন কিন্তু পড়ে থাকে সঙ্গীতেই।
মেকানিক থেকে রেডিওতে সুযোগ এবং আজকের মেহেদী হাসান হওয়ার পেছনের গল্প অন্য অনেকের মত তিনি শুনিয়েছেন ঢাকার সাংবাদিক শরাফুল ইসলামকেও। সেটা ১৯৮৫ সালের কথা। সার্ক সম্মেলন উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন মেহেদী। সেসময় ঢাকায় শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে একটি বাংলা গজল রেকর্ড করাতে আসেন এই মহান গায়ক। সেখানে তার একটি সাক্ষাৎকার নেন শরাফুল ইসলাম। (সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন রুনা লায়লা। তিনি উর্দুভাষী মেহেদীর কথা বুঝতে ও শরাফুলের প্রশ্ন মেহেদীকে বোঝাতে সহায়তা করেন। )
ওই সাক্ষাৎকার-আলাপচারিতায় ফুটে ওঠে আমাদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে মহান শিল্পীর সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন। পাকিস্তানি শাসকদেরও সমালোচনা ফুটে ওঠে তাতে। এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় শরাফুল ইসলামের নেওয়া মেহদীর সাক্ষাৎকারের প্রয়োজনীয় অংশটুকু উপস্থাপন করা হলো-
“গাড়ির মেকানিক থেকে বিখ্যাত গায়ক হওয়ার প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে তিনি ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান রেডিওর কর্মকর্তা জেড বুখারী এবং রফি আনওয়ারের নাম শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, আমি ঠুমরিতে অডিশন দেই। ওনারা শুনে এত খুশী হন যে, আমার বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, আমি পাশ করে গিয়েছি। শুরু হয় আমার ঠুমরি গাওয়া। রাগ খাম্বাজ, পিলু দেশ, তিলক কামোদ, বাদী-সমবাদী আমার কণ্ঠে শুনে তাদের পাশাপাশি সঙ্গীত মহলেও প্রশংসিত হয়।
মেহেদী হাসান বলেন, ধীরে ধীরে আমি আমার জানা রাগগুলোকে সংমিশ্রণ করে রেডিওতে দু’একটা গজল গাওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী যে, আমার গায়কী কিভাবে যেন সবার মনকে স্পর্শ করে। প্রশংসিত হয়। তখন বুখারী সাহেব এবং আনওয়ার সাহেব আমাকে রেডিওতে গজলের পার্টটাইমার শিল্পী হিসাবে বিশেষ সুযোগ দেন। এভাবেই আমি গজল শিল্পী হয়ে উঠি।
এদিকে, মেহেদী হাসানের মুখে ১৯৫২ সালের কথা আসতেই, আমার মনে পরে যায়, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ভাষা আন্দোলনের কথা। জানতে চাই, ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার জন্য যে আন্দোলন হয়েছে, তা আপনি কিভাবে দেখেন?
উত্তরে মেহেদী হাসান বলেন, এটা খুব দুঃখজনক বিষয়। এটা আমাদের তৎকালীন শাসকদের একরোখামি। তা না হলে, মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন হবে, গুলিতে শহীদ হবে, বিশ্বে এমন নজির নেই। যারা শহীদ হয়েছেন তারা মহান। শাসকদের অহংকারেই আজ আমরা বিচ্ছিন্ন। জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করলে যা হয়, আমাদের বেলায় তাই হয়েছে। তাই শাসক নয়, প্রয়োজন দেশ পরিচালকের। শুধু ক্ষমতায় যাওয়া নয়। দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করলে অহংকার আসবে না। তা না হলে মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন হবে কেন? এটা তো মৌলিক অধিকার। তা ছাড়া কোনো কিছুই যে জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না এবং চাপাতে গেলে তার ফলাফল যে শুভ হয় না- এটাই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
মেহেদী হাসান আরও বলেন, আজও আমি এখানে এসেছি একটি বাংলা গান গাওয়ার জন্য। আগেও গেয়েছি। সুতরাং বাংলা ভাষা আমিও ভালোবাসি। ”
তার গাওয়া সেরা গজল ও ফিল্মি গানগুলোর মাঝে কয়েকটি’র প্রথম কলি এখানে উল্লেখ করা হলো- পেয়ার ভারে দো শার্মিলি নায়েন, মুঝে তুম নাজারসে গিরা তো রাহে হো মাগার মুঝে কাভি তুম ভুলা না পাওগি, শোলা থা জাল বুঝা হাওয়ায়ে মুঝে না দো, জিন্দেগিমে তো সাভি পেয়ার কিয়া কারতে হ্যায়, কেয়া টুটা হ্যায় আন্দার আন্দার, হাম লিয়ে হোশ কি নাজরানে চালে আতে হ্যায়, রাফতা রাফতা ও মেরি হাস্তি কা সামা হো গায়ি, তেরি ভিগে বাদান কি খুশবুসে লেহেরেভি হুয়ি মাস্তানি সি, রাঞ্জিশহি সাহি দিল হি তো দুখানা হ্যায়, ম্যায় হোশ মে থা তো ফির, কিউ হামসে খাফা হো গায়ে আয় জানে তামান্না, তানহা থি আওর হামেশা সে তানহা হ্যায় ইয়ে জিন্দেগি হায় জিন্দেগি নাম মাগার কেয়া হ্যায় জিন্দেগি, কু বা রু কি তারহা ফয়ল গায়ি বাত শানাসাই কি, লাগি লাগান অ্যায়সি, সাবকে দিলমে রাহতা হু পার দিলকা আঙ্গান খালি হ্যায়।
আপন কণ্ঠ মাধুর্যে ভক্ত-শ্রোতাদের হৃদয়ে আসন পেতে বসা মেহেদী হাসান এবার সবার হৃদয়-মন খালি করে দিয়ে চলে গেছেন অনন্তলোকে। তবে তারপরেও তার কণ্ঠের আর গায়কীর ভক্তদের ভালোবাসা নিশ্চয়ই হৃদয়ের সেই শূন্যস্থানগুলো পূর্ণ করে রাখবে অনাগত কাল।
এই মেহেদী হাসান সেই গুটিকয় পাকিস্তানিদের একজন, যিনি নিজেদের একচোখা, একরোখা শাসক শ্রেণী আর সিংহভাগ জনগণের সম্পর্কে সত্যি কথাটা জানতেন, বুঝতেন। তার চলে যাওয়ার এই দুঃখদায়ক সময়টায় আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
পুনশ্চ: গজল সম্পর্কে আলাপচারিতায় গজলের ইতিবৃত্ত জানতে চাইলে গজল সম্রাট বলেন, ভারত বর্ষে গজলের সূচনা হয় ১২শ শতাব্দীতে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, পারস্যের কবি সাউদা, মীর তাকি, মীর জাউক পার্সী ভাষায় গজলের ধারা প্রবর্তন করেন। আর মীর্জা গালিব গজলের পাইওনিয়ার হিসাবে খ্যাত। মেহেদী হাসান বলেন, গজলের সুগভীর বাণী, সাধনার সুমহান বার্তা, আধ্যাত্মবাদের কৌশলসহ সার্বিকভাবে এর জনক হিসাবে অভিষিক্ত হয়ে আছেন কবি আমীর খসরু। তিনি সঙ্গীতের ধ্রুপদ কলা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কারসহ খেয়াল ও বিভিন্ন ধারার প্রবর্তক।
মেহেদী হাসান আরও বলেন, পরবর্তীতে গজলকে সর্বজন প্রিয়তার জন্য ব্যাপকভাবে শ্রোতা তৈরিতে যাঁদের অবদান নতশিরে স্বীকার করতে হয়, তাঁরা হলেন ওস্তাদ বারাকাত আলী খান, মুক্তার বেগম এবং বেগম আক্তার।
কৃতজ্ঞতা: কেউ জানে কেউ জানে না, শরাফুল ইসলাম
বাংলাদেশ সময় : ০০১১ ঘণ্টা, ১৪ জুন, ২০১২