ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মিস্টার টয়লেট!

শেরিফ সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৫৫, জুন ২০, ২০১২
মিস্টার টয়লেট!

‘টয়লেট’ শুনলেই সবাই লজ্জায় লাল। কেউ আবার মুচকি হেসে ওঠেন।

এ বিষয়ে জনসম্মুখে কিছুই বলতে চায় না। অথচ প্রতিটি মানুষের জীবনে ‘টয়লেট’ শব্দটির একটি আলাদা গুরুত্ব আছে।

তবে জ্যাক সিম এমন একজন মানুষ, যিনি টয়লেট নিয়ে কথা বলতে মোটেও অস্বস্ত্বিবোধ করেন না। বরং প্রতিটি নোংরা টয়লেটের ছবি তুলে তাকে কিভাবে আরও পরিস্কার করে তোলা যায়, এ বিষয়ে কাজ করেন। একই সঙ্গে বিশ্বের যেসব জায়গায় টয়লেট নেই, এখানে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট তৈরিতে প্রচারণা চলান।

ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সূত্র মতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭২ ভাগ জনগোষ্ঠি স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পায় না। আরও ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে ডায়রিয়া। এটি একমাত্র স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের অভাবেই হয়ে থাকে।

এসব তথ্যই সিমকে দারুণ ভাবিয়ে তোলে। ১৯৫৭ সালে সিঙ্গাপুরে সিমের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ব্যবসায়ীক পরিবারে বেড়ে ওঠেন। মা ছিলেন গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাই ব্যবসার প্রতি ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ জন্মে। বড় হয়ে নামকরা ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন বুনতে থাকেন সিম।

কিন্তু বলতে গেলে ওই সময়ে সিঙ্গাপুর ছিল দরিদ্র দেশের কাতারে। সুযোগ-সুবিধার দারুণ অভাব ছিল সেখানে। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যেতে থাকে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। এর আগেই সিম মাত্র ২৪ বছর বয়সে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি টাইলসের ব্যবসা করতেন।

হুট করেই সিমের ব্যবসার প্রতি অনাগ্রহ জন্মায়। এটি ১৯৯৭ সালের কথা। যখন সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত মজবুত হয়ে উঠেছ। ওই সময়ে কিম একদিন বললেন, আমার সামনে প্রয়োজনীয় খাদ্য আছে। থাকার মত ভালো ঘর আছে। রাতে আরামে ঘুমানোর মতো অর্থ আছে। সুতরাং নতুন আর কোনো ব্যবসা দরকার নেই। যা আছে এটাই নিয়মিত গতিতে চলতে থাকবে।

সিম তখন সাফল্যময় জীবনকে সার্থক করার চেষ্টায় ব্রত হলেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বহু সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করলেন। মানুষের সেবায় কাজ করতে থাকলেন। কিন্তু এরপরও তার মন ভরছিল না। বারবার তার মনে একটাই কথা, সৃষ্টিকর্তা ঠিক কোন কাজটি করার জন্য তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন?

এমন প্রশ্নের সদুত্তর সিম খুঁজে পেলেন। একদিন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী গো চোক টং ঘোষণা দিলেন, সিঙ্গাপুরের প্রতিটি পাবলিক টয়লেটকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে। কেউ যেন স্বাস্থ্যকর টয়লেটের অভাবে অসুস্থ না হয়ে পড়ে, এ বিষয়ে সরকার কাজ করবে। প্রয়োজনে পুরো সিঙ্গাপুরের প্রতিটি জায়গায় ‘পাবলিক টয়লেট’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ ঘোষণার পরই সিম যেন হাতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের সুযোগ পেলেন। এ সময় সিঙ্গাপুর রেস্টরুম অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা পায়। এদের কাজই হলো, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট তৈরি করা। পরে দরিদ্র নাগরিকদের জন্য এ অ্যাসোসিয়েশন টয়লেট স্থাপনে কাজ শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সীমানা পেরিয়ে সিম জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ১৫টি স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর বিশ্বব্যাপী এ প্রচারণা শুরু হয়।

বিশ্বে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন পদ্ধতি প্রয়োজন। এ বিষয়টির গুরুত্ব পায় ২০০১ সালে। এ বছর ওয়ার্ল্ড টয়লেট অরগানাইজেশনের যাত্রা শুরু হয়। এর দপ্তর প্রতিষ্ঠা হয় সিঙ্গাপুর এবং কম্বডিয়ায়। সিম সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্যাপক কাজ শুরু করেন।

ওয়ার্ল্ড টয়লেট অরগানাইজেশনের মূল লক্ষ্য ছিল, সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করা। বিশ্বে এ বিষয়ে প্রচারণা চালাতে প্রয়োজন অর্থ। সুতরাং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে এ সংগঠনটি তাদের কাজ শুরু করে। সঙ্গে ওয়ার্ল্ড টয়লেট সামিটের আয়োজন করে এ ইস্যু নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সুযোগ করে দেওয়া।

সিম এ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যায় পড়েন। স্যানিটেশন পদ্ধতির কথা আসলেই বিশুদ্ধ পানির বিষয়টি আসে। পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সিমও এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেন। এর সঙ্গে ব্যবসা নিয়েও সিম ভাবতে থাকেন।

ব্যবসায়ীরা যাতে স্যানিটেশন অর্থাৎ স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট তৈরিকেও একটি ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেন। তার কথার গুরুত্ব বুঝে ২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড টয়লেট অরগানাইজেশন কম্বোডিয়াতে এ ব্যবসার একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেন।
এখানে পুরো স্যানিটেশন পদ্ধতি তৈরি করে দেওয়া হবে। স্থানীয় মানুষজন সবাই মিলে টাকা শোধ করবে। পাশাপাশি সেই টয়লেটের পাশে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও করা হবে। এ প্রজেক্টে সবাইকে বিষ্মিত করে ৪ হাজার টয়লেট বিক্রি হয়।
এটি ২০ হাজার মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। কম্বডিয়ার সাফল্যের পর সারাবিশ্বে এ ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। ওয়ার্ল্ড টয়লেট অরগানাইজেশন এরপর ভারতে এ আইডিয়াটি নিয়ে আসেন।
এ সম্পর্কে সিম বলেন, ব্যবসায়ীদের মানুষের সহযোগিতামূলক ব্যবসা করা উচিত। এ ব্যবসা যত বেশি জনপ্রিয়তা পাবে, বিশ্বের তত মঙ্গল হবে।

সিমের সোচ্চার হওয়ার পর সারাবিশ্বে স্যানিটেশন পদ্ধতি ছড়িয়ে যেতে থাকে। ওয়ার্ল্ড টয়লেট অরগানাইজেশনের শুরু সিঙ্গাপুর এবং কম্বডিয়াতে। এ সংগঠন বর্তমানে বিশ্বের ৫৮টি দেশে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।

সিঙ্গাপুরে সিমের উদ্যোগে ওয়ার্ল্ড টয়লেট কলেজ গড়ে উঠেছে। যেখানে পড়ানো হয়, রেস্টরুম ডিজাইন, হাইজিন টয়লেট আর্কিটেক্ট, টয়লেট ক্লিনার্স এবং স্যানিটেশন অ্যান্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। এ কলেজে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করে যাচ্ছে।
জ্যাক সিমের এ কাজটি বিশ্বে বিপ্লব করে ফেলার মতো। অথচ খুব একটা আলোচনায় সিম নেই। প্রাকৃতিক নিয়মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কাজ করা সিম নিরবেই থাকেন। তাকে সিঙ্গাপুরে সবাই ‘মিস্টার টয়লেট’ বলে ডাকেন। এ নামে সিম পরিচিত হতে গর্ববোধ করেন। কারণ তার কাছে এটি একটি মহৎ কাজ। সিম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যদি সময় থাকতো তাহলে আমি বিশ্বের প্রতিটি জায়গায় স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন করতাম। কিন্তু সময় খুবই কম। তারপরও যতদিন বেঁচে থাকবো আমি এ কাজটি আনন্দের সঙ্গেই করে যাবো।

নিজের কাজ নিয়ে সিম বলেন, ভালো উদ্দেশ্য কাজ কর, অবশ্যই ভালো কিছু হবে। এখানে গণনার কিছু নেই। এতে সব কিছুই ভালোই হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১২
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।