ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় শান্ত জলের ধর্ম সাগর...

মুনিফ আম্মার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:২৭, জুন ২০, ২০১২
পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় শান্ত জলের ধর্ম সাগর...

দীর্ঘ জট। সামনে গাড়ির লম্বা সারি।

মনের কোণে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। সেরেছে, আজ বুঝি আর কুমিল্লা পৌঁছা যাবে না। গাড়িতে বাজতে থাকে কোলকাতার আধুনিক গান “তুমি না থাকলে সকালটা আজ মিষ্টি হতো না”। যাত্রীরা কেউ কেউ বলে বসলেন, “সকাল আর মিষ্টি হতে হবে না....। ”

কুমিল্লার প্রথম যাত্রাটা এমন বিরক্তিকর হবে তা আগে মনে হয়নি। বিশেষ করে যাত্রাসঙ্গী রুবী নাহারের কাছে কুমিল্লার যে বর্ণনা শুনেছি, তাতে অন্তত এমনটি মনে হবার কোনো কারণ ছিল না। হাল ছেড়ে চোখ বুঁজলাম।

ঘুম ভাঙ্গলো রুবীর ধাক্কা খেয়ে। এবার আর গান ভেসে এলো না। ‘কান্দিরপাড়, চকবাজার...’ ইত্যাদি অনেক শব্দ শুনতে পেলাম চারপাশ থেকে। ইজিবাইকের চালকরা দলবেঁধে বসে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়। শহরের যে জায়গায় বাস থেকে নামলাম তার নাম শাসনগাছা।

রিক্সা আর অটোবাইক চালকরা যাত্রীদের ওপর এখানে একপ্রকার শাসন করেন বলেই দেখা গেল। তাদের ডাকে সাড়া না দিলে রাঙা চোখের শাসনে পড়তে হতে পারে।

গরম-ঘাম আর ক্লান্তি নিয়ে কুমিল্লা শহরটাকে তখন ভাল করে দেখার ইচ্ছাটা সুপ্ত রইলো। একটা ব্যাটারি চালিত অটোবাইকে চড়ে বসলাম। গন্তব্য নানুয়া দীঘির পাড়। মূল শহর কান্দিরপাড় পেরিয়েই চোখে পড়লো বিশাল এক দীঘি। পাশেই বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ ভিক্টোরিয়া কলেজ। অতোবড় দীঘি দেখে ভেবেছি এটাই বুঝি নানুয়া দীঘি। ভুল ভেঙ্গেছে যখন বাহনটি এ দীঘির পাড়ে যাত্রা বিরতি করেনি। পরে জেনেছি এই দীঘির নাম রাণীর দীঘি। খানিক পরেই নানুয়া দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়াল বাইকটি।

তুলনামূলক নানুয়া দীঘি রাণীর দীঘির চাইতে খানিকটা বড়। এই শহরটায় এতো বড় বড় দীঘি দেখে অবাক হলাম খুব। আজকাল শহরের মাঝেও এতো বড় দীঘি থাকতে পারে!

মত বদলালাম; শহর ঘুরে দেখতে হবে এখনই। যে শহর জলের সাথে এতো সুন্দর মিতালী পাতায়, সে শহর দেখার ইচ্ছার কাছে ক্লান্তিরা হার মেনেছে। বেরিয়ে পড়লাম অল্পসময়ের মধ্যেই।

বাহন হিসেবে জুটল রিক্সা। সোজা চলে গেলাম ধর্মসাগর পাড়ে। বলা চলে শহরের ঠিক মাঝখানে ধর্মসাগরের অবস্থান। প্রথম দেখাতেই ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমনিতেই জলের প্রতি আমার দারূণ টান, তার ওপর ধর্মসাগরের জল কেমন শান্ত বয়ে চলছে বাতাসের ছোঁয়ায়- মুগ্ধ না হওয়ার মত এতটা বেরসিক আপনি হতে পারবেন না।

ধর্মসাগরের নাম শুনে সাগর মনে হলেও এটা আসলে বড় একটা দীঘি। রানীর দীঘি ও নানুয়া দীঘির চাইতেও বড়। প্রাচীনকালের গল্পে অতো বড়ো দীঘির নাম শোনা যায়। বাস্তবে ধর্মসাগরের মত বড় দীঘির দেখা মেলে খুবই কম।

সেদিন ধর্মসাগর পাড়ে দিনের আলো খুব একটা পাইনি। তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার প্রিয় মুহূর্তটি ধরা দিয়েছে বেশ আপন করে। শহরের মাঝে হলেও কোলাহলমুক্ত ধর্মসাগর। পাড় জুড়ে অসংখ্য মানুষের আড্ডা। কুমিল্লা ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে প্রতিদিনই মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। কোমল বাতাসের দোলায় মন ভরাতে সবাই ছুটে আসে এখানে।

অদ্ভূত সুন্দর এক আবেশ ছড়িয়ে আছে ধর্মসাগরের জল আর পাড় জুড়ে। দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠেছে কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়। বেশ পুরোনো একটি দালানে চলে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। সামনে সবুজ ঘাসের মাঠটি দেখে অনায়াসে গা এলিয়ে দিতে মন চাইবে।

বিকেল হলে এ মাঠেও আড্ডা জমিয়ে তুলে ধর্মসাগর দেখতে আসা মানুষগুলো। ধর্মসাগরের পুরো পশ্চিমপাড়টা বেশ সুন্দর করে সাজানো। পায়ে হাঁটার দারূণ রাস্তা। রাস্তার পাশে একটু পর পর বসার ব্যবস্থাও আছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে একটু জিরিয়ে নিতেও পারবেন।

উত্তর পশ্চিম কর্নারে বেশ সুন্দর করে বানানো হয়েছে ‘অবকাশ’। গোল ছাউনি দেয়া বিশ্রাম নেওয়ার এ ‘অবকাশে’ প্রায় জমে ওঠে বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডা আর ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শহরের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষগুলোর প্রিয় একটি স্থান এটি। উত্তরপাড় থেকেই শুরু হয়েছে কুমিল্লা পৌর উদ্যান। ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ এক। যদিও অযত্ন আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। তবুও ইট পাথরের শহরে এমন সবুজের দেখা পাওয়া কম কিসে?

প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের আওতায় থাকা রাণীর কুঠিটিও ধর্মসাগরের পাড়েই। উত্তর পাশের মাঝামাঝি জায়গা জুড়ে অবস্থিত এটি। কয়েকশ বছরের পুরোনো রাণীর কুঠি’র ইতিহাসও অনেক বিস্তৃত। লাল ইটের রাণীর কুঠি’তে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। সামনের সুবিশাল সিঁড়িই বলে দেয়, এ সিঁড়ি বেয়ে একসময় তৎকালীন বৃটিশ শাসক-কর্মকর্তাদের উঠানামা ছিল। বর্তমানের আমরাও উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে।

ভিতরটা অন্যরকম সুন্দর। বসার জায়গাটাতে এখনো সেই পুরোনো ধাঁচ রয়ে গেছে। রুম পেরিয়ে পিছন দিকটায় যেতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। রানী’র কুঠি’র এ দিকটায় বাতাসের ধাক্কায় ধর্মসাগরের জল আছড়ে পড়ে। শান বাঁধানো বড় একটা ঘাট। নামতে নামতে একদম পানির খুব কাছে গিয়ে মিশে গেছে। উত্তর পাড়ে হওয়ায় দখিনের সব বাতাস ভীড় করে এখানে এসে।

রাণী’র কুঠি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।

প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের প্রাক্তণ ভাণ্ডার রক্ষক আবুল কাশেম জানালেন, রাণীর কুঠি একসময় পল্লী উন্নয়ন একাডেমির আওতায় ছিল। তারা এটিকে অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করতো। গেল বছর সরকার গেজেট করে রাণীর কুঠিকে প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করে।

Dhormo-Sagorধর্মসাগর পাড়ের ঐতিহ্যমণ্ডিত এ কুঠিকে নগর জাদুঘর করার দাবি করছেন কুমিল্লার অনেকেই।

কুমিল্লা কালচারাল কমপ্লেক্স আর সংস্কৃতি সদন অফিস- সবই ধর্মসাগরের পাড়ে। কুমিল্লা আর্ট কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্মসাগরের পাড় ঘেঁষেই। মুক্তবুদ্ধি চর্চার এ যেন এক উন্মুক্ত উদ্যান। সময় কাটানো, ঘুরে বেড়ানোই নয় কেবল, ধর্মসাগর পাড়ে নিয়মিত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আসর জমে ওঠে। কুমিল্লার নাট্য ও কবিতা আবৃত্তির দলগুলো তাদের অনুশীলন কর্মযজ্ঞ নিয়ে বসে এই ধর্মসাগর পাড়েই।

ধর্মসাগর ঘিরে এত সব আয়োজনের চিত্র দেখে মুগ্ধতায় মন ভরে গেল। কুমিল্লায় যাবার পথে যানজটের কবলে পড়ে পানসে হয়ে আসা অনুভূতিটা দূর হয়ে গেল মন থেকে। ধর্মসাগর দর্শনের পর মনে হল-- এর চাইতে বেশি কষ্ট পেয়ে হলেও বারবার আমি ছুটে আসবো ধর্মসাগর পাড়ে। এখানকার জল-বাতাসে নিজেকে নিমগ্ন করার চাইতে আনন্দ আর কি হতে পারে?

বাংলাদেশ সময় : ১৯৪৫ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১২
এমএ/সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।