গণিতবিদদের গণিতবিদ বলা হয় রামানুজনকে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, রামানুজনকে কেউই তেমন চেনেন না।
মাদ্রাজের গরীব গোঁড়া হিন্দু পরিবারে ১৮৮৭ সালে তার জন্ম। তার পুরো নাম শ্রীনিবাসা রামানুজন আয়েংগার। ছোটবেলা থেকেই অংকের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। বয়স যখন ১৫ বছর তখন তার এক বন্ধু তাকে ‘সিনোপসিস অব পিওর ম্যাথমেটিক্স’ নামে একটি বই জোগাড় করে দেয়। সেই বইয়ে ছিল এলজেবরা, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি এবং ক্যালকুলাসের ছয় হাজার থিওরেম। সারাদিন তিনি বসে বসে বইটি পড়তেন।
মেধাবী রামানুজন ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন স্কলারশিপ নিয়ে। কিন্তু ভারতবর্ষে ছিল ইংরেজ উপনিবেশ। ইংরেজিতে পারদর্শী না হলে পড়াশোনা করা কঠিন। তাই তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সারাদিন নিজের মনের মতো করে গণিত নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। জগতের কোনো কাজেই তার উৎসাহ নেই। একমাত্র গণিতই তার ধ্যান-জ্ঞান। মা-বাবা দেখলো ছেলেকে সংসারে ফেরানো উচিত। তাই মাত্র বাইশ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো।
এরপর রামাজুনের মধ্যে পরিবর্তন ঠিকই আসলো। আগে সে অর্থ নিয়ে চিন্তা করতো না। কিন্তু এখন তার সংসার আছে। অংকে ডুবে থাকলে চলতে না; উপার্জনও করতে হবে। তখন তিনি দেখলেন একমাত্র অংক ছাড়া তিনি আর কিছুই পারেন না। তারপরও নেমে পড়লেন চাকরির খোঁজে।
রাজমানুজনকে একজন বুদ্ধি দিলেন রামচন্দ্র রাও নামে একজনের সঙ্গে দেখা করতে। সেই ব্যক্তি নাকি গণিতের ভক্ত। রামানুজন তার কাছে গেলেন। তাকে বোঝালেন ইলিপটিকেল ইনটেগ্রাল হাইপার জিওমেট্রিক সিরিজ। পৃথিবীর মানুষ তখনও এ বিষয়ে কিছুই জানে না। রামচন্দ্র তার কথা কিছুই বুঝলেন না। তবে এটা নিশ্চিত হলেন যে তার সামনে এক প্রতিভাবান গণিতবিদ বসে আছেন।
যাইহোক, রামানুজন মাদ্রাজের পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরি পেলেন। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে তিনি গণিত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মাত্র তেইশ বছর বয়সে জার্নাল অব ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটিতে তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়।
রামচন্দ্র সবাইকে রামানুজনের গণিত প্রতিভার গল্প করতেন। সবাই রামানুজনকে বললেন কেমব্রিজের অংকের অধ্যাপক জিএইচ হার্ডিকে চিঠি লেখতে। রামানুজন ভয়ে ভয়ে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিটি ছিল,
জনাব,
অধীনের বিনীত নিবেদন এই যে, আমি মাদ্রাজের পোর্ট ট্রাস্টে একজন কেরানি, মাসিক বেতন দেড় পাউন্ড। আমার বয়স তেইশ। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি নয় কিন্তু আমি অবসর সময়ে অংক চর্চা করিয়া থাকি। আমি ডাইভারজেন্স সিরিজের ওপরে একটু কাজ করিয়াছি, তার ফলাফল স্থানীয় গণিতবিদরা ‘অসাধারণ’ বলিয়া মনে করিতেছেন। আমি আপনাকে আমার কিছু ফলাফল লিখিয়া পাঠাইলাম। আমি অত্যন্ত দরিদ্র, তাই যদি এইগুলোর কোনো প্রকার গুরুত্ব রহিয়াছে মনে করেন আপনি তাহা প্রকাশের দায়িত্ব নিলে কৃতজ্ঞ থাকিব। আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত অল্প তাই আপনার উপদেশ আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান বলিয়া বিবেচিত হইবে।
আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করিবার জন্য আন্তরিক দুঃখিত।
বিনীত
আপনার একান্ত অনুগত
রামানুজন
চিঠির শেষে হাতে লেখা ১২০টি থিউরেম ছিল।
রামানুজনের চিঠি পেয়ে হার্ডি হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝলেন পৃথিবীতে এক অসামান্য গণিতবিদ এসেছেন। রামানুজনের থিওরেমগুলোর কোনো কোনোটি তিনি আগে দেখেছেন, কোনো কোনোটি পৃথিবীর অন্য বড় গণিতবিদরা প্রমাণ করে রেখে গেছেন, রামানুজন জানতেন না বলে নিজে আবার করেছেন। কয়েকটা থিউরেম হার্ডি নিজে অনেক কষ্টে প্রমাণ করে দেখলেন কিন্তু বেশির ভাগই তার নাগালের বাইরে। সবকিছু দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি তাড়াতাড়ি রামানুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
হার্ডি চেষ্টা করতে থাকলেন রামানুজনকে কেমব্রিজ নিয়ে আসতে। কিন্তু রামানুজন কিছুতেই রাজি হন না। তিনি গোঁড়া হিন্দু। সমুদ্র পাড়ি দিলে জাত নষ্ট হবে। এসময় তার মা স্বপ্নে দেখলেন নামগিরি দেবী তার ছেলেকে আশীর্বাদ করে বিদেশ যেতে বলছে। রামানুজন কেমব্রিজ হাজির হলেন।
রামানুজনকে দেখে হার্ডি অবাক হয়ে গেলেন। এতবড় গণিতবিদ আধুনিক গণিতশাস্ত্রের কিছুই জানতেন না। রামানুজনের গণিতের উপর যে পরিমাণ দখল ছিল ঠিক সে পরিমাণ দুর্বলতাও ছিল। এই নিয়েই অবাক হলেন হার্ডি। অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান জানেন রামানুজন। অন্যদিকে গণিতের অনেক সহজ সমাধান নিয়ে তার কোনো ধারণাই নেই। তাই হার্ডি উদ্যোগ নিলেন রামানুজনকে আধুনিক গণিতশাস্ত্র শেখানোর। একইসঙ্গে তার ভয়ও ছিল। যদি আধুনিক গণিতশাস্ত্র শেখাতে গিয়ে রামানুজনের রহস্যময় ক্ষমতার কোনো ক্ষতি হয়? তারপরও হার্ডি ঝুঁকি নিলেন। পড়ানো শুরু করলেন। তবে হার্ডির ভাষায়, তাকে আর শিখিয়েছি কতটুকু, আমিই শিখেছি তার কাছ থেকে।
এরপর তার প্রতিভা আরো প্রকাশিত হতে থাকে। নিত্য নতুন শিক্ষায় তার প্রতিভার ঝলক গণিতবিদদের অবাক করতে থাকে। কিন্তু ১৯১৭ সালে রামানুজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর তিনি সুস্থ হননি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণিতবিদরা এই রোগা মানুষটিকে সম্মান জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা তাকে গণিতবিদদের গণিতবিদ বলে উল্লেখ করলেন।
অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসলেন ১৯১৯ সালে। তার এক বছরের মধ্যে যক্ষ্মায় এই গণিতবিদ মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। এই বিশ্বমানের গণিতবিদকে দেশে ফেরার আগেই তাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। তাকে রয়াল সোসাইটির সদস্য এবং ট্রিনিটি কলেজের ফেলো করা হয়।
কিন্তু এই অসাধারণ গণিতবিদ ভারতীয় উপমহাদেশে খুব একটা জনপ্রিয় ব্যক্তি নন। গণিত নিয়ে তার ভাবনা বলতে গেলে ইতিহাস থেকে যেন হারিয়েই গেছে।
[ গণিতকে জনপ্রিয় করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মোহাম্মদ কায়কোবাদ। দুজনই তরুণদের জন্য নিজেদের সাধ্যমত কাজ করে চলেছেন দুরন্ত গতিতে। ২০১০ সালে গণিতের নানান সমস্যা নিয়ে দুজনের রচনায় তাম্রলিপি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায় ‘নিউরনে অনুরণন’ বইটি। এই বইয়ে দুইশ গাণিতিক সমস্যা আছে। গণিত নিয়ে চিন্তা করতে শেখাবে এই বইটি। এই বইয়ে গণিতের নানান সমস্যার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন গণিতবিদদের জীবনী বর্ণনা আছে। সেখান থেকেই রামানুজনের জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে দেওয়া হয়েছে। ]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক