ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘যতই ছবি তোলেন কোনো লাভ নাই’

মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:০০, জুন ২৭, ২০১২
‘যতই ছবি তোলেন কোনো লাভ নাই’

ঢাকা: মঙ্গলবার। দুপুর দেড়টা।

রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে হাঁটছিলাম। ভরদুপুর হওয়ার কারণেই কি না কে জানে চারপাশে মানুষজন কম। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য অলস সময় কাটাচ্ছেন।

হঠাৎ চোখ আটকালো অনতিদূরে এক গাছের নিচে। বসে মালা গাঁথছেন এক ব্যক্তি। কেনো জানি তার সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছে জাগলো মনে। কাছে গিয়ে দেখলাম, ৪০-৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি উচ্ছিষ্ট ফুল দিয়ে মালা গাঁথছেন।

এ দৃশ্য দেখেই বললাম- ভাই একটা ছবি তুলবো! তিনি বললেন, না!  আপনারা যতই ছবি তুলেন কোনো লাভ নেই। আপনারা ছবি তুললে আমাদের কোনো কাজে আসে না। আপনারা তো ছবি তোলেন আপনাদের কাজের জন্য, আমাদের জন্য না। যান আমাকে কাজ করতে দেন, তাড়াতাড়ি মালাগুলো গাঁথতে হবে। বিকেলে আবার এগুলো বিক্রি করতে হবে। আপনারা তো ছবি তুলেই টাকা পান, আমরা পাই না বুঝলেন।

এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বললেন, আপনার মতো সাংবাদিকরা প্রত্যেকদিন এখানে শুধুই আমাদের বিরক্ত করতে আসে।

সাংবাদিকদের প্রতি এত বিরক্ত কেন দুলালের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, `প্রতিদিন কাজের সময় তারা আমাদের বিরক্ত করেন। এমনিতে তো থাকি নানান চিন্তায়, তারপরও কত্ত রকমের প্রশ্ন করেন। এগুলা আর ভালো লাগে না। `

এ কথা শেষেই তিনি আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তারপরও আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম দুলালের পাশে।

এ সময় আমাকে দেখে থেমে থেমে তার জীবনের কঠিন সময়ের গল্প বলা শুরু করলেন। এক সময় হু হু করে কেঁদেই ফেললেন দুলাল। বললেন ভাই, `নিজ এলাকা মেহেন্দিগঞ্জে থাকা অবস্থায় কারও বাড়িতে চুরি হলে আমাকে এসে ধরতো। কারণ, ওই এলাকার একমাত্র অভাবী মানুষ ছিলাম আমি। আমি নাকি অভাবের কারণে চুরি করি। আর সেই চুরির অপরাধে আমাকে অনেক নির্যাতন করেছে এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। `

তিনি বলেন, `তাদের নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে এসেছি ঢাকায়। এখানে আসার পর অনেক দিন বেকার থেকেছি। আমার স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজের ভাগের খাবার নিয়ে আসতো আমাদের জন্য। তারপর সেই খাবার খেতাম আমরা। কত রাত যে খাবারের জন্য ছেলে-মেয়েরা আমার কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, এখনও আমি সেদিনের কথাগুলো ভুলতে পারি না। `

দীর্ঘ আলাপচারিতায় দুলাল জানালেন, তার বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়। বর্তমানে তিনি থাকেন রাজধানীর খামার বাড়ির পাশে মনিপুরি পাড়ায়।   ২০০০ সালে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে কাজের সন্ধানে ছুটে আসেন ব্যস্ত নগরী ঢাকায়।

ঢাকায় এসে প্রতিদিন কাজের সন্ধানে ছুটেছি বিভিন্নস্থানে। প্রথম কয়েকদিন কাজ না পেয়ে অনেক কষ্টে কেটেছে আমার সংসার। পরিবারে সদস্য সংখ্যা মাত্র ৪ জন। ৭ বছরের এক ছেলে ও  তিন বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। ছোট এ সংসার নিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে আমাকে।

এক সময় কাজ হিসেবে বেছে নিই রিকশা চালানোকে। কিছুদিন রিকশা চালানোর পর এ পেশায় খাটুনি অনেক বেশি ভেবে পেশা বদলে ফেলি। পরবর্র্তী পেশা হিসেবে বেছে নিই ফুল কুড়ানোর কাজ। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীররাত পর্যন্ত নগরীর শাহবাগ মোড়ে বস্তা নিয়ে উচ্ছিষ্ট ফুল কুড়াই।

সারারাত ফুল কুড়িয়ে সকালে সেগুলো বাসায় নিয়ে পরিষ্কার করে চন্দ্রিমা উদ্যানে নিয়ে মালা গাঁথি। তারপর সেগুলো পাইকারি বিক্রি করি স্থানীয় ফুল বিক্রেতাদের কাছে। প্রতিদিন ফুল বিক্রি করে মাত্র তিনশ’ টাকা আয় হয়। এ টাকা দিয়ে কোনোমতে চলে আমার সংসার।
    
ব্যস্ত এই শহরে দুলালের মতো হাজারো মানুষের সংসার চলে কোনো না কোনোভাবে। তাদের নিয়ে ভাবার অনেকে আছে কিন্তু সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিদিন কোনো কোনো মিডিয়ায় তুলে ধরা হয় দুলালদের জীবনকাহিনী। সরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, কিন্তু ‘বাস্তবায়নের সংখ্যা অতি নগন্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১২
এমএএস/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।