মস্কো (রাশিয়া) থেকে: আগেই বলেছি, মস্কো শহরের সারা শরীরজুড়ে কথা বলে ইতিহাস। এই শহরের মতো গোটা দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতিও অনেক সমৃদ্ধ।
নিউ জেনারেশন প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে রাশিয়ার ভিক্টরি মিউজিয়াম পরিদর্শন সত্যিই একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল। জাদুঘরটিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক লাখ দশ হাজার বর্গমিটারজুড়ে থাকা জাদুঘরটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় সামরিক সংগ্রহশালা। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালে চলমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনী ও এর দোসরদের বিরুদ্ধে রুশ সেনা ও জনগণের আত্মত্যাগের স্মরণে তৈরি এই জাদুঘর। একই সাথে এটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুশ জাতির লড়াই, সাহস, অধ্যবসায় আর গৌরবময় বিজয়েরও প্রতীক।
সন্ধ্যার একটু পর হিম হাওয়া মেখে যখন আমরা জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম, বাইরের ছিমছাম সাজসজ্জা দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখনো জানি না, ভেতরে কী কী নিদর্শন ও শিল্পকর্ম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে এই জাদুঘরে প্রায় তিন লাখ প্রদর্শনী সামগ্রী আছে। এছাড়া জাদুঘরটিতে পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন পুরনো নিদর্শনও তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো যে মুগ্ধ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জাদুঘরের প্রতি আমার প্রথম থেকেই আলাদা একটা আগ্রহ আছে। সেই সুবাদে দেশের নামকরা এবং প্রয়োজনীয় প্রায় সব জাদুঘরই মোটামুটি ঘুরে দেখেছি, তাদের নিদর্শনগুলো নিয়ে স্টাডি করেছি, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেগুলোর ইতিহাসে ডুব দিয়েছি। বিভিন্ন সেমিনার থেকে এটাও জেনেছি যে, দেশের জাদুঘরের তুলনায় বিদেশি জাদুঘরগুলোর সিস্টেম অনেক ভালো। এখানে আমাদের দেশের মতো মূল্যবান নিদর্শনগুলো অযত্ন-অবহেলায় মেঝেতে পড়ে নষ্ট হয় না। এদের নিদর্শন সজ্জার ভঙ্গিমাও অনন্য। সেইসব চিন্তাভাবনা নিয়ে যখন জাদুঘরের নিদর্শনগুলোর দিকে পা বাড়ালাম, তখন সত্যিই বিস্ময়ে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার উপায়।
জাদুঘরের মূল নিদর্শনগুলো দেখার উদ্দেশে যখন পা বাড়ানো হবে, তখন যে বিষয়টি সবচেযে বেশি নজর কাড়বে এবং মনোযোগ আকৃষ্ট করবে, তা হলো ইতিহাসকে দেখানোর ও জানানোর পদ্ধতি। নিদর্শন তো রয়েছেই, সঙ্গে ভাস্কর্য, শিল্পকর্ম, বিভিন্ন চিত্রকল্প আর থ্রিডি ইফেক্টের মাধ্যমে আপনাকে ইতিহাসের ঠিক সেই সময়টিতেই দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। যেন যুদ্ধের মাঠে আপনি সবকিছু অবলোকন করছেন উপর থেকে। সেই সময় মিশে যাবে আপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যা সত্যিই রাশিয়া এবং বিশ্বের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে একটি অবিস্মরণীয় যাত্রা।
নিদর্শন চোখে পড়লো এখানকার জাদুঘরের মেঝেতেও। তবে তা অবহেলায় নয়, বরং এই সজ্জা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে যে আপনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়টিতেই এক বিদ্ধস্ত শহরের ভাঙা রাস্তায় পা ফেলে হেঁটে চলেছেন। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে অগণিত যুদ্ধবিমান। পাশে পড়ে অগণিত লাশ। তার মধ্যে শিশু-কিশোর-যুবক-বয়স্ক সবাই আছে। এ যেন এক যুদ্ধের ময়দান!
এভাবেই জাদুঘরের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা জাদুঘরের বিস্তৃত সংগ্রহ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, যা রাশিয়ার সামরিক ইতিহাসের বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। নিবিড়ভাবে সংরক্ষিত শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে সমস্ত প্রদর্শনী পর্যন্ত, প্রতিটি কোণ জাতির ত্যাগ ও বিজয়ের সাথে অনুরণিত। এছাড়া স্ট্যান্ডআউট ডিসপ্লেগুলোর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধকালীন শিল্পকর্ম, মহান নেতাদের ব্যক্তিগত গল্প এবং মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের প্রতি মর্মস্পর্শী শ্রদ্ধাঞ্জলি। এই সময়ের আবর্তনে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এসব নিদর্শনের দিকে তাকিয়ে শুধু মনে হয়, এসব বীরত্বের এক মর্মান্তিক অনুস্মারক যা রাশিয়ার বিজয়ের পথকে রূপায়িত করেছে দীর্ঘ সময় ধরে।
ব্যাটল ফর মস্কো: ফার্স্ট ভিক্টরি; ফিট অফ দ্য পিপল; হল অব ফেইম; দ্যা ওয়ার্ল্ড আফটার দ্য ওয়ার; হল অব জেনারেলস; ফিট অব দ্যা আর্মি; হল অব হিস্ট্রোরিক্যাল ট্রুথ; হল অব দ্য ফেস অব ভিক্টরি; এবং হল অব মেমরি অ্যান্ড সরো-এর মতো বিষয়গুলো নিয়ে জাদুঘরটিতে চলে প্রদর্শনী।
এদের মধ্যে ‘ব্যাটল ফর মস্কো: ফার্স্ট ভিক্টরি’ প্রদর্শনীটি যুদ্ধের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে করা হয়েছে। এই প্রদর্শনী শহরের রক্ষাকর্তাদের স্মৃতিতে উত্সর্গ করা হয়েছে। ১২০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত নয়টি ঐতিহাসিক বিভাগে, যুদ্ধকালীন মস্কোর দৃশ্য ঐতিহাসিক নির্ভুলতার সাথে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এই অংশে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মস্কোবাসীদের জীবন্ত শৈল্পিক চিত্র দেখানো হয়েছে। এগুলি দর্শনার্থীদের মস্কোর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের এবং শহরের রক্ষাকর্তাদের ভাগ্য এবং বীরত্বের কীর্তির সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়। প্রদর্শনীটিতে ১৭০০টির বেশি নিদর্শন রয়েছে, যার মধ্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম. ইফ্রেমভের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, বিখ্যাত জেনারেল ডোভাতোর এল., জনগণ মিলিশিয়ার সদস্যরা নাট্যকার ভি. রোজোভ, ভি. ভোরোনচেনকো এবং আরও অনেকে অন্তর্ভুক্ত।
‘ফিট অব দ্য পিপল’ প্রদর্শনীটি জাদুঘরের যুদ্ধের ভয়াবহতায় জমকালো একটি প্রদর্শনীটি। তিন হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই প্রদর্শনী, যা হোম ফ্রন্ট কর্মীদের বিজয়ের অবদানকে উপস্থাপন করে, যাদের মধ্যে দেশের হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসা, সংস্কৃতিসহ যারা নিঃস্বার্থভাবে মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে যুদ্ধের কঠিন বছরগুলিতে দেশের স্বার্থে কাজ করেছিলেন। অনন্য উপস্থাপনায় প্রদর্শনীটি ইতিহাসের ধারণা এবং দৃশ্যাবলির সংমিশ্রণের উপর ভিত্তি করে চিত্রিত করা হয়েছে, যা কেবল ঐতিহাসিক তথ্যই শেখায় না, সেই সময়ের ঘটনাগুলোকে আবেগঘনভাবে অনুভব করতে দেয়।
আর যুদ্ধের ওপর গুরুত্বআরোপ করার পাশাপাশি, ভিক্টরি জাদুঘরটি রাশিয়ার সামরিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিয়ে অন্যান্য ঐতিহাসিক সংঘাতকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। নেপোলিয়নিক যুদ্ধ থেকে শুরু করে আরও সাম্প্রতিক বিষয় পর্যন্ত, জাদুঘরটি দেশের সামরিক বিবর্তনের একটি বৃহৎ ধারণা প্রদান করে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও জাদুঘরটির প্রতি সকলের মর্মস্পর্শী শ্রদ্ধা, যত্ন সহকারে কিউরেট করা প্রদর্শনী, উদ্ভাবনী উপস্থাপনা এবং স্মরণের মাধ্যমে জাদুঘরে অন্তত এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে, অতীতের বলিদানগুলি ভুলে যাওয়া হবে না কখনোই। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠেছে, যুদ্ধের প্রতিধ্বনি অনুরণিত হয় এবং যেখানে একটি জাতির আগামী প্রজন্ম তা উদযাপন করে।
মিউজিয়ামটির সবচেয়ে বড় যে দিকটি মন কাড়ে, তা হলো জাদুঘরে এর নিদর্শনের উপস্থিতি। যুদ্ধের সেই সময় কেমন ছিল তা বোঝানোর জন্য সেই ময়দানটিকেই, সেই ধ্বংসস্তূপটিকে গোটা তুলে ধরা হয়েছে একটি হলের মধ্যে, যা আপনাকে সেই সময়ে নিয়ে যাবে। এমনকি কিছু নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেলেও সেরকম চিত্রকল্প করেই থ্রিডির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে ধ্বংসস্তূপ হিসেবে ব্রিজ, দোতালা দালান, তার বড় বড় থাম আর যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে থাকা বড় বড় বৃক্ষও, যা এক নিমিষেই বদলে দেবে আপনার জাদুঘর দেখার অভিজ্ঞতা।
সেই অনন্য অভিজ্ঞতা নিয়েই জাদুঘর থেকে বের হলাম আমরা। কেননা একদিনে এই জাদুঘরের সব কিছু দেখা সম্ভব নয়। পাশ থেকে ভারতের ইতিহাস বিষয়ে পিএইচডি গবেষণ হরিনারায়ণ রাজীব এবং সার্বিয়ার শিক্ষক জোভানা স্টোকি বলে উঠলেন, এ সত্যিই অনন্য। বিশেষ করে সাজসজ্জা। জাদুঘরটির মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মানুষের জীবন সম্পর্কে জানা যায়, যা অন্যরকমের অভিজ্ঞতা। আর সম্মুখ সারির যোদ্ধা ছাড়াও বেসামরিক মানুষরা কীভাবে যুদ্ধকালে তাদের দিন পার করেছে, তা জানাও খুবই চমকপ্রদক।
সত্যিই তাই। জাদুঘরটিতে আসার অনুভূতি খুবই সুন্দর। এখান থেকে ইতিহাস জানা আপনাকে আনন্দ দেবে। এছাড়া এখানকার প্রদর্শনী অতীতের মানুষের জীবন ও তাদের অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেবে। যা জীবনের এক অসামান্য অর্জন, অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সেই রেশ নিয়ে বের হলাম জাদুঘর থেকে। অনেক্ষণ হিটার রুমের একটু গরম আবহাওয়ায় থাকার পর বাইরের ফুরফুরে শীতল হাওয়া বেশ ভালো লাগলো এবার। সে হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। তারপর গ্রুপে থাকা একমাত্র ভারতীয় বন্ধুর গলা জড়িয়ে রওনা হলাম বাসের খোঁজে। সে ক্ষণ তার জন্মদিন, যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে রুমে ফিরে তাই মিষ্টি খাওয়ার পালা এবার।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা বলে মস্কোর শরীরজুড়ে
১৮০ রুবলের দেনা মাথায় নিয়ে শুরু মস্কোয় পথচলা!
উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো এক ঝাপটা শীতল হাওয়া
সাদা রাতের শহরে
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৩
এইচএমএস/এমজেএফ